
ছবি: সংগৃহীত
ইরান ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যকার বহু প্রতীক্ষিত পঞ্চম দফার পরমাণু আলোচনা সম্প্রতি ওমানের মধ্যস্থতায় ইতালির রাজধানী রোমে অনুষ্ঠিত হলেও তা কার্যত অচল অবস্থায় পৌঁছেছে। যদিও উভয়পক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে একে ‘গঠনমূলক’ আখ্যা দিয়েছে, বিশ্লেষকরা বলছেন—আলোচনায় বাস্তব অগ্রগতি বলতে কিছুই হয়নি। বরং একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে দুই পক্ষের মধ্যে তীব্র মতপার্থক্য এই আলোচনাকে বারবার অচলাবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
নিচে আলোচনা থমকে যাওয়ার পেছনের পাঁচটি প্রধান কারণ বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো, যা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়—কেন এই আলোচনার গতি থেমে গেছে এবং কেন সমঝোতার পথ এখনও দূরবর্তী।
১. ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ: আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে পারমাণবিক বিভেদ
এই আলোচনার সবচেয়ে স্পর্শকাতর এবং জটিল ইস্যু হলো ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ। যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্ররা দীর্ঘদিন ধরেই আশঙ্কা করছে, ইরান শান্তিপূর্ণ কর্মসূচির আড়ালে গোপনে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি করতে চাইছে। অন্যদিকে ইরান সবসময় এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছে—তাদের পরমাণু কর্মসূচি শুধুই শান্তিপূর্ণ ও বেসামরিক চাহিদা পূরণের জন্য।
এই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেওয়া প্রতিনিধি স্টিভ উইটকফ স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “ওয়াশিংটন এক শতাংশ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণও মেনে নেবে না।” তার বক্তব্য ছিল, যতদিন ইরান তাদের সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি চালিয়ে যাবে, ততদিন কোনো চুক্তি সম্ভব নয়।
ইরানের প্রতিক্রিয়াও ছিল তীব্র। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাঘচি পরিষ্কার জানিয়েছেন, এই বিষয়ে তারা কোনো ধরনের ছাড় দিতে রাজি নন। এক টুইটে তিনি বলেন, “শূন্য পারমাণবিক অস্ত্র = চুক্তি সম্ভব, কিন্তু শূন্য সমৃদ্ধকরণ = চুক্তি অসম্ভব।” দুই পক্ষের এই অবস্থানগত পার্থক্যই আলোচনাকে কার্যত স্থবির করে দিয়েছে।
২. আলোচনা কাঠামো নিয়ে মতানৈক্য: শুধু পরমাণু না, নাকি আরও?
তেহরান চায়, আলোচনা যেন শুধুমাত্র পরমাণু কর্মসূচি এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এই সীমারেখা মানতে নারাজ। তারা চায়, আলোচনার পরিধি বাড়িয়ে সেখানে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি এবং আঞ্চলিক প্রভাব বিস্তার, বিশেষ করে লেবাননের হিজবুল্লাহ, গাজার হামাস এবং ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের প্রতি ইরানের সমর্থন নিয়েও আলোচনা হোক।
ইরানের দৃষ্টিকোণে এই ইস্যুগুলো দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা ও সার্বভৌম অধিকারসংশ্লিষ্ট বিষয়। তারা একে ‘অভ্যন্তরীণ প্রতিরক্ষা নীতি’ হিসেবে ব্যাখ্যা করছে এবং বলছে—এসব নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ নেই। এই ইস্যুতেও দুই পক্ষের মতপার্থক্য এতই গভীর যে তা আলোচনার কাঠামোকেই সংকুচিত করে ফেলেছে।
৩. নিষেধাজ্ঞার ছায়া: আলোচনা চলাকালেও চাপ অব্যাহত
আলোচনার আগে এবং চলাকালেই যুক্তরাষ্ট্র একাধিক নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ইরানের ওপর। বিশেষ করে ইরানের নির্মাণ খাত, তেল ও গ্যাস খাতে নিষেধাজ্ঞার ফলে তেহরানে ব্যাপক অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাঈল বাকায়ি অভিযোগ করেন, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো মূলত মার্কিন সদিচ্ছাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলছে। তিনি বলেন, “একদিকে আলোচনা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক অবরোধ—এটা দ্বিচারিতা ছাড়া কিছু নয়।” ইরানের মতে, যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে একযোগে আলোচনার টেবিলে বসে আবার নিষেধাজ্ঞাও জারি করছে, তাতে করে আলোচনার প্রতি তাদের আন্তরিকতা নিয়ে সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই নিষেধাজ্ঞাগুলো শুধু আলোচনার পরিবেশকে দূষিত করছে না, বরং আলোচনার সম্ভাব্য সাফল্যকেও ধ্বংস করছে।
৪. সামরিক উত্তেজনা ও হুঁশিয়ারি: আলোচনার বাইরে যুদ্ধের মেঘ
আলোচনার সমান্তরালে দুই দেশের মধ্যকার সামরিক উত্তেজনাও আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত সপ্তাহে ইঙ্গিত দিয়েছেন, যদি আলোচনা ব্যর্থ হয় তবে সামরিক পদক্ষেপ নেওয়া হতে পারে। এই বক্তব্য ইরানে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে।
ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ হোসেইন বাগেরি পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন, “যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো ধরনের সামরিক অভিযান চালায়, তার ফলাফল হবে আফগানিস্তান ও ভিয়েতনামের অভিজ্ঞতার চেয়েও ভয়াবহ।” তিনি জানান, ইরান যেকোনো আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রস্তুত এবং এর কড়া জবাব দেবে।
এই ধরনের হুমকি ও পাল্টা হুঁশিয়ারি শুধু কূটনৈতিক পরিবেশকেই বিষাক্ত করছে না, বরং আলোচনার সম্ভাব্য শান্তিপূর্ণ ফলাফলকে আরও অনিশ্চিত করে তুলছে।
৫. তৃতীয় পক্ষের প্রভাব: ইসরাইল-সৌদি চাপ কি আলোচনা ঠেকাচ্ছে?
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আলোচনা থমকে যাওয়ার পেছনে তৃতীয় পক্ষ—বিশেষ করে ইসরাইল ও সৌদি আরব—গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু সম্প্রতি ঘোষণা দিয়েছেন, তারা ইরানের পরমাণু স্থাপনায় হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই হুমকি ইরানকে আরও সন্দিহান করে তুলেছে।
ইরানের রক্ষণশীল সংবাদমাধ্যম ‘কায়হান’ তাদের এক সম্পাদকীয়তে লিখেছে, “ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর সমন্বিত চাপের কারণেই আলোচনার কাঠামো কৃত্রিমভাবে বাড়ানো হচ্ছে, যাতে চুক্তি ব্যর্থ হয়।” তারা আরো অভিযোগ করে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলের চাপেই আলোচনার বিষয়বস্তুতে নতুন নতুন বিষয় সংযোজন করছে, যা আলোচনাকে ঘোলাটে করছে।
এছাড়াও সৌদি আরবের আঞ্চলিক প্রতিযোগিতামূলক দৃষ্টিভঙ্গিও ইরানকে রক্ষণাত্মক করে তুলেছে। ফলে, এই তৃতীয় পক্ষগুলোর প্রভাবও আলোচনার স্থবিরতার একটি অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সমঝোতা কি আদৌ সম্ভব?
বর্তমানে ইরান-যুক্তরাষ্ট্র পরমাণু আলোচনা কার্যত স্থবির অবস্থায় রয়েছে। ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ, আলোচনার কাঠামো, নিষেধাজ্ঞা, সামরিক উত্তেজনা এবং তৃতীয় পক্ষের প্রভাব—এই পাঁচটি বিষয় দুই দেশের মধ্যে এমন গভীর মতবিরোধ তৈরি করেছে যে আপাতত কোনো তাৎক্ষণিক সমঝোতার সম্ভাবনা দূরাশাই মনে হচ্ছে।
তবে, সব সংকটের মধ্যেও একটি আশাবাদের বার্তা রয়েছে—উভয়পক্ষ এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা থেকে সরে দাঁড়ায়নি এবং ভবিষ্যতে সমঝোতার সম্ভাবনা রাখছে। আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক মহলও এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বিভিন্ন মাধ্যম ও ফোরামে উভয়পক্ষকে সংলাপ চালিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, যতক্ষণ পর্যন্ত না উভয়পক্ষ মূল ইস্যুগুলোর ব্যাপারে নমনীয়তা দেখাবে, ততদিন এই আলোচনা কার্যকর ফলাফল বয়ে আনবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ