
ছবি: সংগৃহীত
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে দেশজুড়ে চলছে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি। ঈদের মূল অনুষঙ্গ কোরবানির পশু নিয়ে যেন কোনো অনিয়ম, অনুপ্রবেশ বা নিরাপত্তা হুমকি তৈরি না হয়, সেজন্য সরকার এবার সীমান্তে কঠোর নজরদারির ব্যবস্থা নিয়েছে। গত কয়েক দশকে ঈদুল আজহা মানেই ছিল ভারত থেকে আসা গরুর প্রাচুর্য, কিন্তু এবার সেই দৃশ্যপট অনেকটাই বদলে গেছে। দেশে উৎপাদিত গবাদিপশুই এবার কোরবানির চাহিদা মেটাতে প্রস্তুত, এমনকি চাহিদার চেয়ে প্রায় ২০ লাখ পশু অতিরিক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়।
আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কঠোর নির্দেশনা, সমন্বিত বাহিনী মোতায়েন
সম্প্রতি সচিবালয়ে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় কোরবানির পশুর চলাচল, পরিবহন, নিরাপত্তা এবং সীমান্তে অনুপ্রবেশ রোধে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সভায় অংশ নেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জননিরাপত্তা বিভাগ, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), কোস্ট গার্ড, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষসহ একাধিক দপ্তর।
সভা শেষে জানানো হয়, ঈদুল আজহা উপলক্ষে দেশের প্রতিটি সীমান্তজেলায় বিজিবি, পুলিশ, জেলা প্রশাসন, প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা, স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ—সমন্বিতভাবে নজরদারির দায়িত্ব পালন করবে। লক্ষ্য একটাই: কোনোভাবেই যেন অবৈধভাবে গবাদিপশু দেশে প্রবেশ করতে না পারে।
সীমান্তে নজিরবিহীন কড়াকড়ি
এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. হুমায়ুন কবির বলেন, “দেশে পর্যাপ্ত সংখ্যক গবাদিপশু রয়েছে। ফলে ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে অবৈধভাবে পশু আসার সুযোগ নেই। সীমান্তে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কাজ করব। প্রতিটি পয়েন্টে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। এমনকি চোরাচালান প্রতিরোধে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহারের কথাও বিবেচনা করা হচ্ছে।”
বিজিবি সূত্র জানায়, সীমান্তে বাড়তি টহল, চেকপোস্ট এবং নজরদারি ড্রোন মোতায়েনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল একেএম নাজমুল হাসান বলেন, “অবৈধ অনুপ্রবেশ শুধু গবাদিপশু নয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষায়ও হুমকি তৈরি করতে পারে। আমরা পুরোপুরি প্রস্তুত।”
ঈদে গবাদিপশু মজুত: চাহিদার চেয়ে ২০ লাখ বেশি
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “আমাদের খামারিরা এখন এতটাই সক্ষম যে দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। এ বছর মোট ১ কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানিযোগ্য পশু রয়েছে। এর মধ্যে ৫৬ লাখ গরু-মহিষ, ৬৮ লাখ ছাগল-ভেড়া এবং ৫ হাজার ৫০০-এর বেশি অন্যান্য প্রজাতির পশু রয়েছে। চাহিদার চেয়ে প্রায় ২০ লাখ গবাদিপশু উদ্বৃত্ত থাকবে।”
এই খাতে একাধিক প্রাণিসম্পদ বিশেষজ্ঞের মতে, দেশে যদি সঠিকভাবে বাজার ব্যবস্থাপনা ও পশু চলাচল নিশ্চিত করা যায়, তাহলে বিদেশি পশুর ওপর নির্ভরতা পুরোপুরি বাদ দেওয়া সম্ভব।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আজিজুল হক বলেন, “গরু মোটাতাজাকরণে আমাদের দেশ এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু সীমান্ত দিয়ে অবৈধ পশু আসলে তা খামারিদের জন্য বড় ক্ষতি। সরকার যে কঠোরতা দেখাচ্ছে, তা অনেক আগেই হওয়া উচিত ছিল।”
পশু পরিবহন: নিরাপত্তা, চিকিৎসা ও আইন প্রয়োগে জোর
চলতি বছর পশু পরিবহন যেন নির্বিঘ্ন হয়, সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, জেলা প্রশাসন ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ যৌথভাবে কাজ করবে। বিশেষ করে ট্রাক ছিনতাই, চাঁদাবাজি ও নৌপথে ডাকাতির মতো ঝুঁকিরোধে থাকবে বাড়তি সতর্কতা।
রেলওয়ের ‘ক্যাটেল স্পেশাল ট্রেন’ এই বছরও চালু থাকবে। চারটি ট্রেনের মাধ্যমে নির্ধারিত রুটে পশু পরিবহন সহজ করা হবে। এছাড়া আরও তিনটি অতিরিক্ত ট্রেন রাখার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
পাশাপাশি, প্রাণিকল্যাণ আইন বাস্তবায়নে পশুর হাটে প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে সব হাটে মেডিকেল টিম থাকবে। ভেটেরিনারি ডাক্তারদের নিয়ে গঠিত মেডিকেল টিমগুলো মনিটর করবে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কেন্দ্রীয় মনিটরিং সেল। পাশাপাশি থাকবে ২৪ ঘণ্টা খোলা হটলাইন (১৬৩৫৮) ও কন্ট্রোল রুম।
রাজধানীতে পশুর হাট ও পরিবেশ-পরিকল্পনা
ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন এবার ২১টি হাটের অনুমতি দিয়েছে। তবে আবাসিক এলাকায় হাট বসানো কিংবা যত্রতত্র পশু জবাইয়ের বিরুদ্ধে কড়া অবস্থানে আছে সিটি কর্তৃপক্ষ। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ইতোমধ্যে আফতাবনগরে পশুর হাট বসানোর বিপক্ষে মত জানিয়েছে এবং সেইমতো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে চিঠি দিয়েছে।
পরিবেশবিদ অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন বলেন, “প্রতি বছর কোরবানির সময় ঢাকার বর্জ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়। এ বছর যদি নির্ধারিত স্থানে কোরবানি এবং জনগণের সচেতনতা বাড়ানো যায়, তাহলে পরিবেশ রক্ষা সম্ভব।”
ঢাকা উত্তর সিটির প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. মোহাম্মদ আজম বলেন, “বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় এবার দ্রুত রেসপন্স টিম থাকবে। প্রত্যেক হাটে ওয়ার্ড পর্যায়ে পরিচ্ছন্নতা কর্মীদের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়েছে।”
হাটে স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল লেনদেন ও বাজার ব্যবস্থাপনা
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে এবার কোরবানির হাটগুলোতে পশু কেনাবেচায় ডিজিটাল লেনদেনেও জোর দেওয়া হচ্ছে। একাধিক অনলাইন প্ল্যাটফর্ম এরই মধ্যে চালু হয়েছে যেখানে মোবাইল ব্যাংকিং কিংবা কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন করা যাবে।
পাশাপাশি প্রতিটি পশুর হাটে পশুর প্রাথমিক চিকিৎসা, টিকা ও সনদ যাচাইয়ের জন্য বিশেষ বুথ থাকবে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ভ্রাম্যমাণ টিম ও ভেটেরিনারি মেডিকেল টিম যৌথভাবে কাজ করবে।
সাম্প্রতিক বছরের পরিসংখ্যান
গত ২০২৪ সালে দেশে মোট ১ কোটি ২৯ লাখ ৮০ হাজার পশু কোরবানিযোগ্য ছিল। তার মধ্যে কোরবানি হয় ১ কোটি ৪ লাখ ৮ হাজার ৯১৮টি পশু। এর আগের বছর (২০২৩) কোরবানি হয়েছিল ১ কোটি ৪১ হাজারটি। ২০২২ সালে সে সংখ্যা ছিল ৯৯ লাখ ৫০ হাজার।
সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয় ঢাকা বিভাগে—প্রায় ২৫ লাখের বেশি। সবচেয়ে কম হয় ময়মনসিংহ বিভাগে।
চলতি বছর কোরবানির ঈদ উপলক্ষে সরকার যে সুনির্দিষ্ট ও কঠোর পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, তা একদিকে যেমন দেশের খামারিদের রক্ষা করবে, তেমনি অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি ও আইনশৃঙ্খলার ওপরও ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। অবৈধ পশুর অনুপ্রবেশ বন্ধ, পরিবহন নিরাপত্তা, পশু স্বাস্থ্য সেবা এবং পরিবেশবান্ধব কোরবানির উদ্যোগ—সব মিলিয়ে এবারের ঈদুল আজহা হতে যাচ্ছে পরিকল্পিত ও সুসংগঠিত।
প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ‘সবচেয়ে বড় কোরবানি হোক দায়িত্ববোধের’।
বাংলাবার্তা/এমএইচ