
ছবি: সংগৃহীত
ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল এক গুরুত্বপূর্ণ আদেশ দিয়েছে। রবিবার (২৫ মে) ট্রাইব্যুনাল নির্দেশ দিয়েছে, শেখ হাসিনাকে আগামী শুনানিতে সশরীরে হাজির হতে হবে এবং সে বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি দুটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করতে হবে। আদালতের এ নির্দেশের মাধ্যমে দেশের ইতিহাসে আরেকটি নজিরবিহীন অধ্যায়ের সূচনা হলো।
ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন বিভাগ জানায়, সম্প্রতি শেখ হাসিনা এক বক্তব্যে বলেন, ‘২২৬ জনকে হত্যার লাইসেন্স পেয়ে গেছি’, যা আদালতের প্রতি চরম অসম্মান ও বিচারিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থাহীনতা তৈরি করে। এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ট্রাইব্যুনাল ‘আদালত অবমাননার’ প্রাথমিক পর্যায়ের অভিযোগ আমলে নিয়েছে। শেখ হাসিনা ও আরেকজন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এই অভিযোগে সশরীরে হাজিরা চেয়ে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের আদেশ দেওয়া হয়েছে।
প্রসিকিউশন বিভাগ আরও জানায়, আদালতকে অবমাননার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে শেখ হাসিনাকে সরাসরি হাজিরা দিতে হবে। এ সংক্রান্ত বিজ্ঞপ্তি আগামী সাত দিনের মধ্যে প্রকাশ করতে হবে।
রবিবারই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপে প্রবেশ করেছে বিচারের যাত্রা। রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের সময় পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হন। সেই ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ আটজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (Formal Charge) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন।
এই মামলার তদন্ত শেষ হয় ২১ এপ্রিল, তদন্তে উঠে এসেছে যে, অভিযুক্তরা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। তারা "গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে চাওয়া" জনতাকে দমন করতে গুলি চালান এবং সহিংসতার নির্দেশ দেন বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রসিকিউটর গাজী এম এইচ তামিম বলেন, “আনুষ্ঠানিক অভিযোগ ট্রাইব্যুনাল আমলে নিলে বিচারিক কার্যক্রমের পরবর্তী ধাপ শুরু হবে। এটি জুলাই বিপ্লবের প্রথম মামলা, তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম।”
এই মামলায় মোট আটজনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে ডিএমপির ইন্সপেক্টর আরশাদ, কনস্টেবল মো. সুজন, কনস্টেবল ইমাজ হোসেন ইমন এবং কনস্টেবল নাসিরুল ইসলাম বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন। বাকি চারজন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা জোনের সাবেক এডিসি শাহ আলম মো. আকতারুল ইসলাম এবং এসি মো. ইমরুল—পলাতক রয়েছেন।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সরকারি দায়িত্বে থেকেও জনগণের বিরুদ্ধে অস্ত্র ব্যবহার করেছেন এবং বেআইনিভাবে হত্যা করেছেন, যা আন্তর্জাতিক অপরাধের আওতায় পড়ে। প্রসিকিউশন মনে করে, এটি মানবতাবিরোধী অপরাধের অন্যতম দৃষ্টান্ত, যেটি বিচারযোগ্য।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট ‘জুলাই বিপ্লব’ নামে পরিচিত ছাত্র-জনতার আন্দোলন ঢাকার রাস্তায় উত্তাল হয়ে উঠেছিল। দাবি ছিল, সুষ্ঠু নির্বাচন, জবাবদিহিমূলক সরকার ও মানবাধিকার নিশ্চিত করা। কিন্তু আন্দোলন দমনে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আগ্রাসী অভিযান বহু হতাহতের কারণ হয়। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়, যা শুধুমাত্র ‘জুলাই বিপ্লব’-এর সময় সংঘটিত অপরাধ তদন্ত ও বিচার করবে।
ট্রাইব্যুনাল ইতোমধ্যে বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড ও নির্যাতনের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে এবং একাধিক মামলার চার্জশিট প্রণয়ন করেছে। এই মামলাগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, এখানে সাবেক প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারাও অভিযুক্ত হচ্ছেন।
এই মামলার অগ্রগতি এবং শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার প্রক্রিয়া রাজনৈতিক অঙ্গনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের নেতারা এ ধরনের বিচারের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, যদিও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বলছে, এ বিচার আইনসঙ্গত এবং প্রমাণভিত্তিক।
অন্যদিকে, নাগরিক সমাজের একটি বড় অংশ এই বিচারকে “জবাবদিহির পথে সাহসী পদক্ষেপ” হিসেবে দেখছে। তাঁদের মতে, “কোনো ব্যক্তিই আইনের ঊর্ধ্বে নয়, তা সে যতই ক্ষমতাশালী হোক না কেন।”
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সর্বশেষ এই নির্দেশ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেকটি স্পর্শকাতর অধ্যায় যুক্ত করেছে। একটি জাতীয় দৈনিকে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আদালতে হাজির হওয়ার নোটিশ—এটি কেবল আইনি প্রক্রিয়ার অংশ নয়, বরং দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। সেইসঙ্গে, ‘জুলাই বিপ্লব’-এর বিচারিক কার্যক্রম যে নতুন মোড় নিচ্ছে, তা পরবর্তী দিনগুলোতে আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ