
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনীতির গতিপথ এই মুহূর্তে এক অনিশ্চিত সংকটের মুখোমুখি। ক্ষণে ক্ষণে বদলাচ্ছে দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, যার প্রভাব পড়ছে সর্বস্তরের মানুষের মনে। সাম্প্রতিক দিনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, আন্দোলন, পদত্যাগের হুমকি এবং সর্বদলীয় সংলাপের দাবি—এসব মিলিয়ে জাতীয় রাজনীতির ভবিষ্যত নিয়ে প্রশ্নের মেঘ জমেছে। এমন পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠছে, দেশ কোন পথে যাচ্ছে? সংকট থেকে মুক্তির পথ কি এবং আগামী জাতীয় নির্বাচন কবে ও কীভাবে অনুষ্ঠিত হবে?
গত কয়েক সপ্তাহে প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের কথা সামনে এসেছে। এতে জনমনে উদ্বেগের মাত্রা বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগের সম্ভাবনা রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রবল ধাক্কা হিসেবে দেখা হচ্ছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুব উল্লাহ মনে করেন, “ড. ইউনূস যদি পদত্যাগ করেন, তা জাতীয় বিপর্যয়ের কারণ হবে। তার জায়গাটা কীভাবে পূরণ হবে, সেটা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। সামরিক শাসন বা অন্য কোন প্রকার কঠোর ব্যবস্থার সম্ভাবনা থাকলে সেটি দেশের গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ধাক্কা।”
তিনি আরো বলেন, “রাজনীতিতে বিভাজন ও ফ্যাসিবাদবিরোধী দলগুলোর মধ্যে ছিন্নমূলতা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। যদি আধিপত্যবাদ পুনরায় ফিরে আসে, তবে সেটি হবে দেশের জন্য এক ভয়াবহ বিপর্যয়। গৃহযুদ্ধের সম্ভাবনাও রয়েছে। এখন সময় এসেছে জাতীয় ঐক্য ও সমঝোতার।”
জামায়াতে ইসলামী দলের আমির ড. শফিকুর রহমান বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি দেশবাসীর জন্য অস্থিরতা তৈরি করেছে। আমরা দ্রুত একটি রোডম্যাপ চাই, যাতে নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হয়। তা না হলে জাতি আবারও সংকটে পড়বে। দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সংস্কার ও বিচার ব্যবস্থাকে দৃশ্যমান করতে হবে।”
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব ড. আহমদ আব্দুল কাদের বলেন, “সরকারকে এখনই নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তার কোনো বক্তব্যই দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে সাহায্য করবে।”
বিএনপি ফরেন অ্যাফেয়ার্স অ্যাডভাইজারি কমিটির বিশেষ সহকারী বদরুল আলম চৌধুরী শিপলু বলেন, “এই সংকট থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো অবিলম্বে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা। উপদেষ্টা পরিষদ ও রাজনীতিবিদদের উচিত সংযত ও দায়িত্বশীল আচরণ।”
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শিশির মনির লিখেছেন, “কাঠামোগত সংস্কার, বিচার, সম্পদ জব্দ, তারপর ২০২৬ সালের প্রথমার্ধে নির্বাচন—এটাই একমাত্র পথ।”
অন্যদিকে, দেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংকট মোকাবেলায় বেশ সচেষ্ট। উপদেষ্টা পরিষদ বারবার বৈঠক করছে, এবং সিদ্ধান্ত নিতে উদ্যোগী। গত শনিবারের বৈঠকে জানানো হয়, “দেশের স্থিতিশীলতা, নির্বাচন ও বিচার প্রক্রিয়ায় এগিয়ে যেতে বৃহত্তর ঐক্য প্রয়োজন। সরকারের কাজ বাধাগ্রস্ত হলে জনসমক্ষে সব তথ্য তুলে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।”
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মো. সাহাবুল হক বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার সবচেয়ে কঠিন সময় পার করছে। দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্যহীনতা, নির্বাচনের তারিখ টানাটানি, উপদেষ্টাদের বিতর্ক—এসব মিলে অবস্থা জটিল। তবে যদি সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতা হয়, তাহলে গণতন্ত্র পুনর্জীবিত হওয়া সম্ভব। এর জন্য রাজনৈতিক ইচ্ছা ও নৈতিক নেতৃত্বের বিকল্প নেই।”
সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার ভূমিকা নিয়ে রাজনৈতিক মহলে রয়েছে ব্যাপক প্রত্যাশা। অনেকেই মনে করেন, তিনি যদি এ সময়ে দায়িত্বশীল নেতৃত্ব দেন, তাহলে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক বলেন, “ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ নয়, বরং প্রয়োজন নির্বাচন ও সংস্কারের রোডম্যাপ। পরাজিত শক্তি ও বিদেশি ষড়যন্ত্র মোকাবেলায় রাজনৈতিক দল ও সরকারকে একত্রিত হতে হবে।”
রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনের তারিখ ও রোডম্যাপ নির্ধারণে চাপ দিচ্ছে। বিএনপি দাবি করছে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন সম্ভব। জামায়াতের রোডম্যাপ নির্ধারণ ছাড়া পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। এনসিপি গণহত্যার বিচারসহ অন্যান্য সংস্কারের দাবিতে জোর দিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা সতর্ক করেছেন, দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘায়িত হলে সামাজিক ও অর্থনৈতিক মূল্য ভয়াবহ হবে। দেশ এখন ঐক্য, সংলাপ এবং স্বচ্ছ রাজনীতির প্রতি বেশি গুরুত্ব দিতে বাধ্য।
বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের রাজনীতি ‘বিপর্যয়ের ধাপ’ স্পর্শ করেছে বলা চলে। দীর্ঘদিন ধরে চলমান রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মধ্যেই সাম্প্রতিক পদত্যাগের হুমকি ও আন্দোলন গুলোর তীব্রতা বেড়েছে। সরকারের পদক্ষেপ এবং রাজনৈতিক দলের ভূমিকা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি এবং অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে। সুষ্ঠু নির্বাচন ও কাঠামোগত সংস্কার ছাড়া রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ নেই। কিন্তু রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আগ্রাসন ও ধ্রুবক অসন্তোষ দেশকে এক বড় অন্ধকারে ঠেলে দিতে পারে।
রাজনীতিবিদ ও বিশ্লেষকদের একমত—সামরিক হস্তক্ষেপ কিংবা শাসন ব্যবস্থা গণতন্ত্রের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক দল এবং সরকারের উচিত দ্রুত ঐক্যমত্য গড়ে তোলা। এসময় জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই। সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার মধুর নেতৃত্ব এই সংকট কাটিয়ে নতুন পথ দেখাতে পারে বলে অনেকের ধারণা।
তবে এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলের ব্যক্তিগত স্বার্থবোধ ও গোষ্ঠী সংঘাত এড়ানো সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। এসময় ধৈর্য্য, সংযম ও স্বচ্ছ সংলাপ ছাড়া দেশের স্থিতিশীলতা ফিরে আসা কঠিন। ২০২৬ সালের নির্বাচনে সুষ্ঠু ভোট ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রত্যাশায় দেশ এখন অপেক্ষার মাঝে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ