
ছবি: সংগৃহীত
বিতর্কিত উপদেষ্টাদের বাদ দিয়ে একটি নিরপেক্ষ উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে দলটি দ্রুত একটি জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণারও দাবি তুলেছে। শনিবার রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠকে এসব দাবি জানায় বিএনপির প্রতিনিধিদল।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, "বাংলাদেশে গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার এবং একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ তৈরি করতে হলে নিরপেক্ষতা অক্ষুণ্ণ রাখা অত্যাবশ্যক। এ লক্ষ্যে আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে স্পষ্টভাবে বলেছি—যে উপদেষ্টারা সরকারের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি নষ্ট করছেন বা জনগণের আস্থা অর্জনে ব্যর্থ হয়েছেন, তাদের বাদ দিয়ে উপদেষ্টা পরিষদ পুনর্গঠন করতে হবে।"
বিএনপি লিখিতভাবে বৈঠকে জানায়, বর্তমানে সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টা, বিশেষ করে নিরাপত্তা উপদেষ্টা এবং দুইজন ছাত্র উপদেষ্টা সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ করছেন। বিএনপির বক্তব্য অনুযায়ী, এই ব্যক্তিরা পূর্ববর্তী সরকারে সক্রিয়ভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁদের উপস্থিতি অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে জনগণের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করছে। তাই তাঁদের অবিলম্বে বাদ দেওয়ার দাবি জানায় বিএনপি।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বিএনপির স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, "আমরা লিখিতভাবে পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করেছি কারা এই সরকারকে পক্ষপাতদুষ্ট করছে এবং তাদের অব্যাহতি দিতে হবে।"
খন্দকার মোশাররফ বলেন, "বিএনপি শুরু থেকেই একটি সুনির্দিষ্ট, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করে আসছে। এই দাবি কেবল রাজনৈতিকভাবে নয়, গণতন্ত্র রক্ষার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি—নির্বাচনের রোডম্যাপ দ্রুত দিতে হবে, যাতে ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে।"
তিনি আরও বলেন, "যেকোনো ধরনের অযৌক্তিক বিলম্ব জনগণের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি করছে এবং তা স্বৈরাচারী অপশক্তিকে সুযোগ করে দিতে পারে। আমরা মনে করি—নির্বাচনের বিলম্ব হলে এর দায় বর্তমান সরকারের ওপরই পড়বে।"
বিএনপির প্রতি নানা ধরনের গুজব ও অপপ্রচারের জবাবে খন্দকার মোশাররফ বলেন, "বিএনপি কখনোই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেনি। বরং সরকার গঠনের শুরু থেকেই আমরা সর্বাত্মক সহযোগিতা করে আসছি। যারা গুজব ছড়াচ্ছে, তারা আসলে সরকারকে অকার্যকর করার চেষ্টা করছে।"
এ বিষয়ে আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় স্পষ্ট হয়েছে যে, তাঁরা সংস্কার ও বিচার প্রক্রিয়া নিয়ে আমাদের সঙ্গে কোনো দ্বিমত করেননি। বরং নির্বাচন ডিসেম্বরের আগেও হতে পারে—এমন কথাও আলোচনায় উঠে এসেছে।”
বিএনপির পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের শাসনামলে সংঘটিত রাজনৈতিক সহিংসতা, মিথ্যা মামলা, দমন-পীড়নেরও বিচার দাবি করা হয়। মোশাররফ হোসেন বলেন, "বিএনপির নেতাকর্মীরা ব্যক্তি, পরিবার ও রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আওয়ামী লীগের সময়। এ কারণে আওয়ামী লীগের বিচার সবচেয়ে বেশি জরুরি। এই বিচার অসম্পূর্ণ থাকলে, আমরা সরকারে গেলে স্বাধীন বিচার বিভাগের মাধ্যমে তা সম্পন্ন করব।"
বিএনপির নেতারা প্রধান উপদেষ্টাকে জানিয়েছেন, নির্বাচন, সংস্কার এবং বিচার—এই তিনটি বিষয় একে অপরের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলার সুযোগ নেই। এগুলো তিনটি স্বতন্ত্র ট্র্যাক, যা একসঙ্গে চলতে পারে। মোশাররফ বলেন, "সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া, যা জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী হতেই হবে। সরকারও আমাদের সঙ্গে ঐকমত্যে পৌঁছে সংস্কারের রূপরেখা দিলে ভালো ফলাফল আসবে।"
বৈঠকে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদলে খন্দকার মোশাররফ হোসেন ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমেদসহ আরও কয়েকজন জ্যেষ্ঠ নেতা।
সরকারের তরফ থেকে এসব দাবি ও প্রস্তাবে কী প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, তা নিয়ে বিস্তারিত কিছু না বললেও বিএনপির নেতারা জানিয়েছেন—তাঁরা এখন প্রধান উপদেষ্টার প্রতিক্রিয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন এবং সেই অনুযায়ী দলীয় পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
বিএনপির দাবি ও অবস্থান নিয়ে দেশের রাজনীতিতে নতুন করে উত্তাপ সৃষ্টি হয়েছে। সরকারের প্রতিক্রিয়া এবং আগামী দিনে নেওয়া পদক্ষেপই নির্ধারণ করবে—নির্বাচনমুখী অন্তর্বর্তী সরকারের ভবিষ্যৎ গতি ও গ্রহণযোগ্যতা।
বাংলাবার্তা/এমএইচ