
ছবি: সংগৃহীত
পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার। দেশের ট্যানারি শিল্প, কাঁচা চামড়া ব্যবসা এবং সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠী যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং কোরবানিদাতারা যেন চামড়ার ন্যায্যমূল্য পান, সেই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই এবারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে।
রোববার, ২৫ মে ২০২৫, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে কাঁচা চামড়ার দাম নির্ধারণ ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এক সংবাদ ব্রিফিং অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিফিংয়ে বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরীসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকায় গরুর লবণযুক্ত চামড়া প্রতি পিস ১৩৫০ টাকা, বাইরের এলাকায় ১১৫০ টাকা
এ বছর ঢাকায় লবণযুক্ত গরুর কাঁচা চামড়ার সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি পিস ১ হাজার ৩৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে এই দাম প্রতি পিস ১ হাজার ১৫০ টাকা। চামড়ার মান, গরুর আয়তন এবং বাজারের বাস্তবতা বিবেচনায় এই দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এছাড়া প্রতি বর্গফুট হিসেবে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ঢাকায় ৬০ থেকে ৬৫ টাকা এবং ঢাকার বাইরে ৫৫ থেকে ৬০ টাকা। এই হিসাব অনুযায়ী, গরুর চামড়ার মূল্য নির্ভর করবে তার আয়তনের উপর, তবে একটি চামড়া ১৩৫০ টাকার কমে কেনা যাবে না ঢাকায়, এবং বাইরের এলাকায় ১১৫০ টাকার নিচে নামানো যাবে না।
খাসি ও বকরির চামড়ারও নির্ধারিত মূল্য
খাসির চামড়ার মূল্য সারাদেশে প্রতি বর্গফুট ২২ থেকে ২৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। অন্যদিকে বকরির চামড়ার দাম রাখা হয়েছে ২০ থেকে ২২ টাকা। অতীতে অনেক সময় খাসি ও বকরির চামড়া সঠিক দামে বিক্রি না হওয়ায় ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছিল। এই বছর চামড়া সংগ্রহকারী, মধ্যস্বত্বভোগী এবং ফাউন্ডেশনসমূহ যাতে স্বচ্ছ লেনদেনে অংশ নেয়, তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
চামড়া ন্যায্যমূল্যে বিক্রি নিশ্চিতের প্রতিশ্রুতি
স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “চামড়ার ন্যায্য মূল্য গরিবের হক। কোরবানির পর অধিকাংশ চামড়া এতিমখানা, মাদ্রাসা ও দরিদ্রদের কাছে চলে যায়। কিন্তু তারা বেশিরভাগ সময়ই চামড়ার উপযুক্ত মূল্য পায় না। তাই এ বছর আমরা এমন একটি ব্যবস্থা করেছি, যাতে তারা বাজারদর অনুযায়ী ন্যায্য মূল্য পায়।”
তিনি আরও জানান, কোরবানির পর শহর এবং গ্রামগঞ্জের পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখার জন্য কঠোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কোরবানির পশু জবাইয়ের পর ১২ ঘণ্টার মধ্যেই সব বর্জ্য অপসারণ করা হবে। সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং স্থানীয় প্রশাসনকে এ বিষয়ে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
হাসিল নিয়ে আলোচনার ইঙ্গিত
চামড়া বিক্রয়ের ক্ষেত্রে মধ্যস্বত্বভোগী বা দালালদের কর্তৃক আদায়কৃত ‘হাসিল’ (কমিশন) বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, “আমরা আলোচনা করেছি যাতে হাসিলের হার ৫ শতাংশ থেকে কমানো যায়। কারণ এটি অনেক বেশি এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিক্রেতারা চামড়ার পুরো মূল্য থেকে বঞ্চিত হন। আমরা চাই, দরিদ্র মানুষ যাতে ন্যায্য মুনাফা পায়। তাদের স্বার্থ রক্ষা করাই আমাদের অগ্রাধিকার।”
আইনশৃঙ্খলা ও চামড়া পাচার ঠেকাতে বিশেষ নজরদারি
প্রতিবছর কোরবানির সময় দেশের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে চামড়া পাচারের অভিযোগ ওঠে। এ বিষয়ে এবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে বিশেষ নজরদারির নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সীমান্ত এলাকায় বিজিবি, র্যাব ও পুলিশ সদস্যদের কড়া তদারকির আওতায় রাখা হবে, যাতে দেশের সম্পদ বাইরে পাচার না হয়।
চামড়ার বাজার যাতে ধসে না পড়ে, সেজন্য আগেভাগেই প্রস্তুতি
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, অতীতে কয়েকবার কোরবানির সময় চামড়ার বাজার ধস নেমেছে। কেউ কেউ চামড়া মাটিতে পুঁতে ফেলেছে, আবার কেউ কেউ রাস্তার পাশে ফেলে দিয়েছে। এসব ঘটনা যেন আর না ঘটে, তাই আগেভাগেই ট্যানারি মালিক, আড়তদার, ফাউন্ডেশন ও স্থানীয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
এছাড়া স্থানীয় পর্যায়ে চামড়া সংরক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত লবণের জোগান নিশ্চিত করা হয়েছে। বাজারে লবণের কোনো সংকট নেই বলে নিশ্চিত করেছেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
সরকারের এই মূল্য নির্ধারণ এবং ব্যবস্থাপনাগত প্রস্তুতির ফলে এ বছর কোরবানির পশুর চামড়ার বাজার নিয়ন্ত্রিত ও স্বচ্ছ থাকবে বলে আশা করা হচ্ছে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—যে দরিদ্র, এতিম ও মাদ্রাসাগুলো এসব চামড়া সংগ্রহ করে, তারা যেন এবারে ন্যায্য মূল্য পায়, এবং চামড়ার মাধ্যমে তাদের যে সাময়িক আর্থিক সহায়তা আসে, সেটি যেন নিশ্চিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ