
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার চলমান টানাপোড়েনের অবসান ঘটিয়ে সমঝোতার পথে এগোচ্ছে দুই পক্ষ। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ জানিয়েছে, তাদের অধিকাংশ দাবি সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসে গৃহীত হওয়ায় আপাতত আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংশোধনীসহ নতুন অধ্যাদেশ জারির আশ্বাসে এই অবস্থান পরিবর্তন আসছে।
আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা আসছে, বলছে ঐক্য পরিষদ
রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যায় এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, “আমাদের সঙ্গে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয়েছে। তারা আমাদের বেশিরভাগ দাবির সঙ্গে একমত পোষণ করেছেন। ফলে আমরা আপাতত আন্দোলন স্থগিত করতে যাচ্ছি। বিস্তারিত একটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানানো হবে।”
এর আগে, দুপুরে এনবিআরের প্রধান কার্যালয়ের নিচে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীরা ‘সম্পূর্ণ কর্মবিরতি’ চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেখান থেকে জানানো হয়, আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এবং ওষুধ ও জীবন রক্ষাকারী পণ্য ছাড়া অন্যান্য সকল কর, কাস্টমস এবং ভ্যাট কার্যক্রম সোমবার (২৬ মে) থেকে স্থগিত থাকবে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের বিবৃতি: অধ্যাদেশে সংশোধনী আসছে
রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় অর্থ মন্ত্রণালয় এক প্রেস বিজ্ঞপ্তি জারি করে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের দাবিগুলোর প্রেক্ষিতে সরকারের অবস্থান স্পষ্ট করে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা গাজী তৌহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২২ মে জারি করা এক প্রেসনোটে সরকারের অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলা হয়েছিল, এনবিআরের কর, কাস্টমস এবং ভ্যাট বিভাগগুলোর সব উদ্বেগের অবসান ঘটানো হবে।
তবে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের সাম্প্রতিক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে কিছু অস্পষ্টতা রয়ে গেছে, যা নতুন বিবৃতিতে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য অনুযায়ী:
এনবিআরকে একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগে রূপান্তর করা হবে, যার প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকবে।
বিসিএস (কাস্টমস ও এক্সাইজ) এবং বিসিএস (কর) ক্যাডারের স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রেখেই এনবিআরকে শক্তিশালী করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।
রাজস্ব নীতি প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নের কাঠামো পৃথক করা হবে একটি বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান গঠনের মাধ্যমে।
এই কাঠামো গঠনের জন্য রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটি এবং সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে অধ্যাদেশে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হবে এবং সংশোধনীর পূর্বে তা কার্যকর হবে না।
অর্থ মন্ত্রণালয় আশা প্রকাশ করে যে, এই পদক্ষেপে এনবিআরের কর্মকর্তাদের সব উদ্বেগ দূর হবে এবং রাজস্ব সংগ্রহ ও সেবা কার্যক্রম পূর্ণ উদ্যমে পুনরায় শুরু হবে।
আন্দোলনের পেছনে যেসব দাবিদাওয়া
এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ দীর্ঘদিন ধরে রাজস্ব প্রশাসনের কাঠামোগত সংস্কার এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রশাসনিক নিরাপত্তার দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছে। তাদের মূল দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে:
জারি করা অধ্যাদেশ অবিলম্বে বাতিল করতে হবে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যানকে অপসারণ করতে হবে।
রাজস্ব সংস্কার বিষয়ক পরামর্শক কমিটির সুপারিশ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে।
প্রস্তাবিত খসড়া ও সুপারিশগুলো নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করে একটি টেকসই এবং গ্রহণযোগ্য রাজস্ব সংস্কার কাঠামো গঠন করতে হবে।
রোববারের সংবাদ সম্মেলনে যুগ্ম কর কমিশনার মোনালিসা শাহরীন সুস্মিতা, উপ কমিশনার আব্দুল কাইয়ুম এবং উপ-কর কমিশনার রইসুন নেসা উপস্থিত ছিলেন। তারা জানান, “আমরা রাজস্ব খাতে একটি পেশাদার ও কার্যকর কাঠামো চাই, যেটা কর্মকর্তাদের অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং জনগণের স্বার্থে টেকসই রাজস্ব নীতি নিশ্চিত করবে।”
আন্দোলনের সাময়িক অবসান, তবে ‘সতর্ক পর্যবেক্ষণ’ চলবে
যদিও আপাতত আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত এসেছে, তবে এনবিআর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন যে তারা সরকারের প্রতিশ্রুতির বাস্তবায়ন পর্যবেক্ষণ করবেন। আগামী ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংশোধনীসহ নতুন অধ্যাদেশ বাস্তবে কতটা অংশীজনের মতামতকে প্রতিফলিত করে—সেই বিষয়ে নিরীক্ষা করা হবে।
আন্দোলনকারী পক্ষ স্পষ্ট করে বলেছে, তাদের দাবি পূরণ না হলে আবারও আন্দোলন শুরু করা হতে পারে।
এই প্রেক্ষাপটে চলমান আন্দোলন সরকারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা হয়ে উঠেছে—যেখানে শুধু প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, অংশীজনদের মতামতের গুরুত্ব, স্বচ্ছতা এবং আলোচনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
বাংলাবার্তা/এসজে