
ছবি: সংগৃহীত
সরকারি চাকরি (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২৫-এর খসড়া অনুমোদনের প্রতিবাদে রোববার দ্বিতীয় দিনের মতো সচিবালয়ের ভেতরে বিক্ষোভ করেছে বাংলাদেশ সচিবালয় কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদ। সংগঠনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, যতক্ষণ না এই অধ্যাদেশ সম্পূর্ণভাবে বাতিল করা হচ্ছে, ততক্ষণ পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া হবে। এদিন দুপুরে পরিষদের সভাপতি মো. বদিউল কবীর আনুষ্ঠানিকভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন এবং কর্মচারীরা সচিবালয়ের বাদামতলা এলাকায় অবস্থান নেন।
কালাকানুন আখ্যা দিয়ে আন্দোলনের ঘোষণা
আন্দোলনরত কর্মচারীরা অধ্যাদেশের খসড়াকে ‘কালাকানুন’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেছেন, এটি জারি হলে সরকারি চাকরিজীবীদের স্বাধীনতা সংকুচিত হবে এবং প্রশাসনে দমন-পীড়নের নতুন পথ খুলে যাবে। মো. বদিউল কবীর বলেন, “সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-তে ইতোমধ্যেই সব আচরণবিধি ও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা রয়েছে। তার পরও নতুন করে অধ্যাদেশের মাধ্যমে নিবর্তনমূলক ধারা সংযোজন করা হচ্ছে, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”
তিনি বলেন, “আমরা এই কালো অধ্যাদেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত সচিবালয়ের মাটিতে থেকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাব। আমাদের দাবি মানা না হলে কর্মসূচি আরও জোরদার হবে।”
সচিবালয়ের ভেতরে টানা বিক্ষোভ
রোববার সকাল থেকেই সচিবালয়ের ভেতরে অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বিপুলসংখ্যক কর্মচারী নিজেদের দপ্তর ছেড়ে মিছিলে যোগ দেন। “অবৈধ কালো আইন মানব না”, “চাকরি নিয়ে খেলবে না”, “গোপন আইন মানি না”—এই ধরনের স্লোগানে সচিবালয়ের পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে।
এর আগের দিন শনিবারও একই দাবিতে বিক্ষোভ করেছিলেন তারা। জানা গেছে, সোমবার থেকে সচিবালয়ের প্রতিটি ভবনে কর্মচারীদের আলাদা করে সংগঠিত করা হবে এবং দাবির পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু হবে। প্রয়োজনে সারা দেশে কর্মচারীদের ঐক্যবদ্ধ করে ঢাকায় অবস্থান কর্মসূচির ডাক দেওয়া হবে।
অভিযোগ: গোপনে আইন তৈরি
সংযুক্ত পরিষদ এবং আন্তঃমন্ত্রণালয় কর্মচারী অ্যাসোসিয়েশন অভিযোগ করেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এই অধ্যাদেশ তৈরি করার সময় কোনো স্টেকহোল্ডার বা কর্মচারী সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা করেনি। বরং গোপনে আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদবিষয়ক বিভাগ থেকে ‘ভেটিং’ নিয়ে সরাসরি উপদেষ্টা পরিষদে উত্থাপন করে অনুমোদন নেওয়া হয়েছে।
সংগঠনের একাংশের সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, “এই অধ্যাদেশের মাধ্যমে কর্মকর্তাদের চাকরি অনিরাপদ করে ফেলা হচ্ছে। চাকরিজীবীদের মধ্যে উদ্বেগ-আতঙ্ক ছড়াতে সরকার সচেতনভাবে এই উদ্যোগ নিয়েছে।”
সাংবিধানিক দ্বন্দ্ব ও শঙ্কা
পরিষদের সভাপতি মো. বদিউল কবীর ও মহাসচিব নিজাম উদ্দিন আহম্মেদ জানান, খসড়ায় যুক্ত করা ‘সরকারি কর্মচারী (বিশেষ বিধান) অধ্যাদেশ, ১৯৭৯’-এর ধারাগুলো সরাসরি বাংলাদেশের সংবিধানের ১৩৫(২) অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে সরকারি চাকরিজীবীদের শাস্তির ক্ষেত্রে বিচারধারার ন্যূনতম মানদণ্ডও মানা হচ্ছে না।
সংগঠনগুলোর মতে, এই আইন কার্যকর হলে প্রশাসনে স্বেচ্ছাচারিতা ও ক্ষমতার অপব্যবহার বেড়ে যাবে। অন্যদিকে, যেকোনো সময় অপছন্দের কর্মচারীকে ছাঁটাই, অব্যাহতি কিংবা পদাবনতি দেওয়ার মাধ্যমে মনস্তাত্ত্বিক চাপে রাখা হবে।
মন্ত্রিপরিষদের অবস্থান
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছে, রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ হলেই এই অধ্যাদেশটি কার্যকর হবে। তবে খসড়ার বিস্তারিত উপাদান বা সংশোধনের ধরন প্রকাশ করা হয়নি।
প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইন সংশোধনের মাধ্যমে এ খসড়া তৈরি করা হয়েছে। তাতে মূলত ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ্যাদেশকে পুনঃসংযোজন করা হয়েছে। এতে কর্মচারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত ছাড়াই বরখাস্ত, পদাবনতি এবং বেতন হ্রাসের বিধান রাখা হয়েছে।
খসড়ার ধারা নিয়ে উদ্বেগ
প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, খসড়ায় চারটি অপরাধ এবং তিন ধরনের শাস্তির কথা বলা হয়েছে:
অনুপস্থিতি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ
কাজে অনাগ্রহ বা আদেশ অমান্য
অন্যকে উসকানি
সংগঠিত অনুপস্থিতি
এই অপরাধগুলোর জন্য শাস্তি হিসেবে বরখাস্ত, পদাবনতি এবং বেতন হ্রাস দেওয়া যাবে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য, তদন্ত ছাড়াই এসব শাস্তি কার্যকর করার সুযোগ রাখা হয়েছে, যা রাষ্ট্রীয় চাকরি কাঠামোয় গুরুতর অনিয়মের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
আইন তৈরির প্রেক্ষাপট
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ মার্চ মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে দেওয়া চিঠিতে জানায়, কর্মস্থলে কর্মচারীদের অনুপস্থিতি এবং সরকারি আদেশ পালনে অনীহার কারণে প্রশাসনিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাই দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ১৯৭৯ সালের বিশেষ বিধান অধ্যাদেশকে আবার কার্যকর করার প্রস্তাব করা হয়। যদিও সেটি সরাসরি না করে ২০১৮ সালের আইনেই যুক্ত করা হয়েছে।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
উল্লেখ্য, ২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে জিয়াউর রহমান সরকারের আমলে জারি করা অনেক অধ্যাদেশ বাতিল হয়ে যায়। ১৯৭৯ সালের এই অধ্যাদেশও সেই তালিকায় পড়ে। তবে ২০১৩ সালে ‘কতিপয় অধ্যাদেশ কার্যকরকরণ আইন’-এর মাধ্যমে এটি বহাল রাখা হয়েছিল। এবার তা পুনরায় কার্যকর করে চাকরি আইনেই স্থায়ীভাবে সংযুক্ত করা হচ্ছে।
আন্দোলন অব্যাহত
কর্মচারীরা জানিয়েছেন, সরকারের এমন সিদ্ধান্ত কর্মক্ষেত্রে উদ্বেগ বাড়িয়েছে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী সংযুক্ত পরিষদের নেতারা আরও বলেন, যদি সরকার এই অধ্যাদেশের খসড়া প্রত্যাহার না করে, তবে তারা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সামনেও অবস্থান কর্মসূচি দেবে।
এদিকে, সচিবালয়ের প্রতিটি দপ্তরে কর্মচারীরা কাজকর্ম ধীর করে দিয়েছেন। যদিও সরাসরি কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়নি, তবে ভেতরে ‘নীরব অসন্তোষ’ পরিষ্কার।
পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ে এ নিয়ে আলোচনার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। তবে এখনো পর্যন্ত সরকারপক্ষ থেকে কোনো ইতিবাচক সংকেত পাওয়া যায়নি।
এই পরিস্থিতিতে সরকারি চাকরি খাত নিয়ে নতুন করে একটি বড় সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, কর্মচারীদের অংশগ্রহণ ছাড়া এমন আইন পাশ করার চেষ্টা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার পরিপন্থী এবং প্রশাসনিক ভারসাম্যে বড় ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ