
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে চলমান রাজনৈতিক বিতর্ক, সামাজিক উদ্বেগ এবং আন্দোলনের পটভূমিতে সরকার পক্ষের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন, সরকার চট্টগ্রাম বন্দরকে বিদেশি কোনো দেশের কাছে বা কোনো আন্তর্জাতিক কোম্পানির হাতে তুলে দেওয়ার চিন্তা করছে না। বরং মূল লক্ষ্য হচ্ছে, বন্দরের কাঠামোগত ও প্রযুক্তিগত সংস্কার এবং ব্যবস্থাপনায় আধুনিকায়ন আনয়নের মাধ্যমে একে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে কার্যকর ও প্রতিযোগিতামূলক বাণিজ্যিক বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা।
রোববার (২৫ মে) রাজধানীর একটি হোটেলে ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) আয়োজিত এক আলোচনাসভায় অংশ নিয়ে এসব কথা বলেন শফিকুল আলম। সেখানে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর কাউকে দিচ্ছি না। বিশ্বের সবচেয়ে বড় বড় কোম্পানিগুলো যাতে এই বন্দরের ব্যবস্থাপনা উন্নত করতে পারে, সেটিই চাই। আমরা চাই তারা টার্মিনালে বিনিয়োগ করুক, অপারেশন চালাক, কিন্তু মালিকানা বা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নয়।”
তিনি আরও জানান, ইতোমধ্যে কয়েকটি আন্তর্জাতিক বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান থেকে বন্দরে তিন বিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগের আগ্রহ পাওয়া গেছে। তবে বিনিয়োগের বিনিময়ে কোনো অংশীদারিত্ব বা কর্তৃত্ব ছাড় দেওয়া হবে না, শুধুমাত্র নির্দিষ্ট টার্মিনাল বা প্রকল্পভিত্তিক ব্যবস্থাপনার সুযোগ দেওয়া হতে পারে।
জাতীয় নির্বাচন প্রসঙ্গে প্রেস সচিব বলেন, “বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার তিনটি দায়িত্ব নিয়ে এসেছে—সংস্কার, বিচার এবং নির্বাচন। এর মধ্যে নির্বাচন হবে আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যেই, তা আগেই বারবার ঘোষণা দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এ তারিখের বাইরে যাওয়া হবে না।” তিনি বলেন, “আগের তত্ত্বাবধায়ক সরকারগুলো শুধুই নির্বাচন পরিচালনায় সীমাবদ্ধ ছিল। কিন্তু এই সরকার আরও গভীর কাজ করছে—প্রতিষ্ঠান সংস্কার, দুর্নীতির বিচার, এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা।”
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৪ মে চট্টগ্রাম বন্দর পরিদর্শনে যান। সেখানে গিয়ে তিনি বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃদপিণ্ড। এই বন্দর বাদ দিয়ে অর্থনীতির নতুন পথ খোলা সম্ভব নয়। আমরা প্রথম দিন থেকেই ভাবছি—কীভাবে এটিকে আধুনিক একটি বন্দর হিসেবে গড়ে তোলা যায়।”
তিনি বলেন, “আমাদের দেশে মাত্র কয়েকটি টার্মিনাল নিয়ে একটি বন্দর চলেছে। অথচ অনেক দেশের রয়েছে ২০-৩০টি কার্যকর টার্মিনাল। এই সংকুচিত অবকাঠামো দিয়ে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির গতি টিকিয়ে রাখা যাবে না। কাজেই এটি শক্তিশালী করা সময়ের দাবি।”
এই মন্তব্য প্রকাশের পর থেকেই বন্দর ‘বিক্রির’ গুজব, বিদেশিদের হাতে ‘তুলে দেওয়ার’ অভিযোগ, এবং জাতীয় সম্পদ রক্ষার দাবি নিয়ে রাজনীতিতে উত্তেজনা তৈরি হয়। একাধিক রাজনৈতিক দল এবং বামধারার সংগঠন রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ শুরু করে। তারা দাবি করে, চট্টগ্রাম বন্দর হলো জাতীয় সম্পদ—এটি বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া যাবে না। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মিছিল, মানববন্ধন এবং সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে সরকারকে এ বিষয়ে ‘সতর্ক’ করা হয়।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম এসব দাবিকে ভিত্তিহীন ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, “বন্দরের উন্নয়ন মানেই বিক্রি নয়। আমরা চাই দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাটি আরও কার্যকর হোক, প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকুক এবং বিশ্বমানের পরিষেবা দিতে পারুক। এর জন্য টেকনিক্যাল সহায়তা, অর্থায়ন ও ব্যবস্থাপনায় আধুনিকীকরণ প্রয়োজন। তবে মালিকানা কখনো হস্তান্তর করা হবে না।”
তিনি জানান, বন্দরে বিনিয়োগে আগ্রহ প্রকাশকারী কোম্পানিগুলোর সঙ্গে সরকারের আলোচনায় ‘ট্রান্সপারেন্ট পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (PPP)’ মডেল অনুসরণ করা হচ্ছে, যাতে জাতীয় স্বার্থ রক্ষা নিশ্চিত করা যায় এবং সরকারি মালিকানা অক্ষুণ্ণ থাকে।
অর্থনীতি ও নৌপরিবহন খাতের বিশ্লেষকরা বলছেন, বন্দরের মতো কৌশলগত স্থাপনায় বিদেশি বিনিয়োগকে বিক্রি বলা একধরনের বিভ্রান্তি। একজন বিশেষজ্ঞ বলেন, “যদি মালিকানা বা দীর্ঘমেয়াদি ইজারা দেওয়া না হয়, তাহলে কৌশলগত বিনিয়োগে সমস্যা নেই। বরং তা প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি, দক্ষতা ও আন্তর্জাতিক সংযোগ নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে পারে।”
তবে তিনি সতর্ক করেন, চুক্তিগুলোকে শতভাগ স্বচ্ছ হতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে কোনো ভুল বোঝাবুঝি না হয় এবং অপপ্রচার প্রশ্রয় না পায়।
চট্টগ্রাম বন্দর নিয়ে উদ্ভূত রাজনৈতিক বিতর্ক ও সামাজিক উদ্বেগের মধ্যেই সরকার পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল, বন্দর কাউকে দেওয়া হচ্ছে না—শুধু আধুনিকায়ন, সংস্কার ও ব্যবস্থাপনা উন্নয়নই লক্ষ্য। প্রেস সচিবের বক্তব্যে এটি স্পষ্ট যে, এই সরকারের মূল নীতি হলো জাতীয় সম্পদকে আরও কার্যকর ও লাভজনক করে গড়ে তোলা, বিদেশিদের কাছে তুলে দেওয়া নয়। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন আন্তর্জাতিক মানে বন্দর উন্নয়নের আশা তৈরি হয়েছে, অন্যদিকে অপপ্রচারের বিরুদ্ধেও সরকারের দৃঢ় অবস্থান স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এখন দেখার বিষয়, রাজনৈতিক অঙ্গনে এ বক্তব্য কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করতে পারে এবং বাস্তব পদক্ষেপ কীভাবে নীতির প্রতিফলন ঘটায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ