
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানী ঢাকার কেন্দ্রে অবস্থিত চানখাঁরপুল এলাকায় গত বছরের ৫ আগস্ট সংঘটিত আলোচিত ‘জুলাই গণহত্যা’র ঘটনায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দায়ের করা মামলায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান হাবিবসহ পুলিশের শীর্ষ ও নিম্নপদস্থ ৮ জন সদস্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিযোগ (ফরমাল চার্জ) দাখিল করেছে প্রসিকিউশন। তদন্ত প্রতিবেদন ও প্রসিকিউশনের ভাষ্যে, এ গণহত্যার নেপথ্যে ছিলো তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশনা—যা বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট পুলিশ বাহিনী ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
২০২৫ সালের ২১ এপ্রিল চানখাঁরপুলে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংক্রান্ত মামলার তদন্ত প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে দাখিল করা হয়। প্রায় ১৯৫ দিনের তদন্ত শেষে প্রস্তুত হওয়া ৯০ পৃষ্ঠার বিশদ প্রতিবেদনে সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয় মোট ৭৯ জন প্রত্যক্ষদর্শীর কাছ থেকে। যদিও ফরমাল চার্জে শেষ পর্যন্ত ৩২ জন সাক্ষীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
এই মামলায় অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তী, রমনা অঞ্চলের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার শাহ আলম ও মো. আখতারুল ইসলাম, সহকারী কমিশনার মো. ইমরুল, শাহবাগ থানার সাবেক পরিদর্শক আরশাদ হোসেন, কনস্টেবল সুজন হোসেন, ইমাদ হোসেন ও নাসিরুল ইসলাম।
তাদের মধ্যে শেষের চারজন বর্তমানে কারাগারে বন্দি আছেন, বাকিরা এখনো পলাতক। ফরমাল চার্জের ভিত্তিতে এখন ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তদন্ত প্রতিবেদনের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু হলো সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং তার ঘনিষ্ঠ মন্ত্রিসভার সদস্যদের দায়। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চলাকালে শেখ হাসিনার সরাসরি নির্দেশে নিরাপত্তা বাহিনী প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করে। ৫ আগস্ট ভোরে শাহবাগ থানার সামনে সংঘটিত হামলায় স্কুলছাত্র শাহরিয়ার খান আনাস, শেখ মাহদি হাসান জুনায়েদ, মো. ইয়াকুব, মো. রাকিব হাওলাদার, মো. ইসমামুল হক ও মানিক মিয়া শহীদ হন।
এই ঘটনায় প্রধানত ডিএমপির কমিশনার হাবিবুর রহমানের অধীনে থাকা পুলিশ সদস্যরা অংশ নেন। তাদের গুলিতে ঘটনাস্থলে বহু মানুষ প্রাণ হারায় ও আহত হয়। তৎকালীন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার সুদীপ কুমার চক্রবর্তীকে অভিযুক্ত করা হয়েছে আন্দোলনকারীদের ওপর গুলির স্পষ্ট নির্দেশদাতা হিসেবে, যিনি ৫ আগস্ট সকাল ৬টায় শাহবাগ থানায় উপস্থিত হয়ে অস্ত্রসহ বাহিনী পরিচালনা করেন।
প্রসিকিউশনের মতে, এই গণহত্যা শুধু স্থানীয় পর্যায়ের কোনো অপরাধ নয়; বরং এটি ছিল কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের সরাসরি নির্দেশে সংঘটিত একটি রাষ্ট্রীয় অপরাধ। এ কারণে শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনের বিরুদ্ধে ‘সুপিরিয়র রেসপনসিবিলিটি’ ধারায় আলাদাভাবে তদন্ত করে আলাদা চার্জশিট প্রস্তুত করা হয়েছে।
চিফ প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জানান, শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের ফরমাল চার্জ প্রায় সম্পন্ন হয়েছে এবং কয়েক দিনের মধ্যেই তা দাখিল করা হবে।
তিনি আরও বলেন, সারা দেশে সংঘটিত অপরাধগুলোর প্রতিটিতে শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বের নির্দেশ ও সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। এই কারণে তাদের বিরুদ্ধে পৃথকভাবে বিচারিক প্রক্রিয়া চালানো হবে।
আশুলিয়ায় ছয় আন্দোলনকারীকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর মামলার তদন্তও শেষ
চানখাঁরপুলের ঘটনায় অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পাশাপাশি আশুলিয়ায় গুলি করে ছয় আন্দোলনকারীকে হত্যার পর মরদেহ পোড়ানোর মামলার তদন্ত কাজও শেষ হয়েছে। তদন্ত সংস্থা জানায়, ওই মামলার পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন রোববার প্রসিকিউশনের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
এই হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রেও একই ‘সুপিরিয়র কমান্ড’ কাঠামোর মাধ্যমে অপরাধ সংঘটিত হয়েছে বলে জানায় প্রসিকিউশন।
তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী, শুধু নিরাপত্তা বাহিনীই নয়, বরং আওয়ামী লীগ, যুবলীগ এবং অন্যান্য অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরাও শেখ হাসিনার নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর হামলা চালায়। ১৪ জুলাই রাতের ওই হামলায় ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর লাঠি, রড, চাপাতি ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে হামলা হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ কমিশনার হাবিবুর রহমান হামলাকারীদের প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, এই মামলায় ফরমাল চার্জ গৃহীত হলে আদালত অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করবেন। এরপর আসামিদের পক্ষে আইনজীবীদের প্রস্তুতির জন্য সময় নির্ধারণ করা হবে এবং প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্টের মধ্য দিয়ে মূল বিচার কার্যক্রম শুরু হবে।
এই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, মোট ৩৩০টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে চলমান তদন্ত রয়েছে ৩৯টির, এবং ২২টি মামলা তদন্তের প্রাথমিক সত্যতা না পাওয়ায় বন্ধ (মিস কেস) হয়েছে।
এই মামলাগুলোতে মোট ১৪১ জন অভিযুক্ত আছেন, যার মধ্যে ৫৪ জন গ্রেফতার অবস্থায় এবং ৮৭ জন এখনো পলাতক। অভিযুক্তদের মধ্যে ৭০ জন বেসামরিক, ৬২ জন পুলিশ সদস্য এবং ৯ জন সামরিক বাহিনীর সদস্য।
প্রসঙ্গত, ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার বড় ধরনের সংকটে পড়ে। নানা সহিংসতা ও মানবতাবিরোধী দমনপীড়নের পর অবশেষে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশত্যাগ করেন। তার এই দেশত্যাগের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রায় ১৬ বছরের শাসনের অবসান ঘটে। সেই ঘটনাপ্রবাহের আইনি ও নৈতিক জবাবদিহি হিসেবেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলছে ‘জুলাই গণহত্যা’ ও সংশ্লিষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ