
ছবি: সংগৃহীত
চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দরে একের পর এক কর্মসূচি ও আন্দোলনের কারণে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র এই বন্দরে কার্যক্রম কার্যত বিপর্যস্ত। সম্প্রতি কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ফলে বন্দর কার্যক্রমে নতুন করে জটিলতা দেখা দিয়েছে। জাহাজ থেকে প্রতিদিন গড়ে হাজার টিইইউস কনটেইনার খালাস হলেও কাস্টমসের কার্যক্রম বন্ধ থাকায় আমদানিকারকরা তা বন্দর থেকে খালাস করতে পারছেন না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির প্রতিবাদে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত ১৪ মে থেকে শুল্কায়ন, পরীক্ষাসহ সব ধরনের কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ রেখে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করছেন। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৪১ হাজার টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক) কনটেইনার জমে গেছে। অথচ বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম নির্বিঘ্ন রাখতে একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টিইইউস কনটেইনার রাখার পর সীমাবদ্ধতা শুরু হয়। এই হার অব্যাহত থাকলে কয়েকদিনের মধ্যে কনটেইনার জায়গা শেষ হয়ে যাবে এবং বাধ্য হয়ে জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্দরের ইয়ার্ডে মোট ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার টিইইউস হলেও কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে ৮ হাজার টিইইউস খালি রাখতে হয়। ফলে বাস্তবিক অর্থে কার্যকর ধারণক্ষমতা ৪৫ হাজার টিইইউস। বর্তমানে বন্দরে ৪১ হাজার টিইইউস জমে রয়েছে, যেটা ধীরে ধীরে সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছে পুরো বন্দর ব্যবস্থাপনাকে।
সাধারণ সময়ে বন্দরে ৩০ থেকে ৩৩ হাজার কনটেইনার থাকে। কিন্তু গত তিন মাসে কনটেইনারবাহী যান চালক ও শ্রমিকদের একাধিক কর্মসূচির কারণে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ মে শ্রমিকদের কর্মসূচির প্রভাবে কনটেইনার খালাসে ধীরগতি দেখা দেয়, ফলে কনটেইনার সংখ্যা তখনই ৩৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। পরবর্তীতে ১৪ মে থেকে শুরু হওয়া কাস্টমস কর্মসূচির কারণে এই সংখ্যা ৪১ হাজারে পৌঁছে গেছে।
চট্টগ্রাম বন্দরে দিয়ে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির ৯৫ শতাংশ শুল্কায়ন হয় চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসে। এই হাউসের কার্যক্রম বর্তমানে সম্পূর্ণ অচল। ফলে আমদানিকারকরা কনটেইনার খালাসের অনুমতি পাচ্ছেন না।
কনটেইনার খালাসে ধীরগতির ফলে তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধ খাতসহ আমদানি নির্ভর শিল্পগুলো সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, “ট্রাম্প প্রশাসনের স্থগিত শুল্ক সুবিধা নেওয়ার জন্য সময় সীমিত। রপ্তানির জন্য কাঁচামাল এখনই দরকার। কিন্তু কাস্টমসে অচলাবস্থার কারণে তা পেতে দেরি হচ্ছে, ফলে সময়মতো রপ্তানি অনিশ্চয়তায় পড়েছে।”
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট ফাল্গুনী ট্রেডার্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইসমাইল খান বলেন, “আজকেও (রোববার) কোনো শুল্কায়ন হয়নি। আবার শুল্কায়নে বিলম্বের কারণে কনটেইনারভেদে চারগুণ পর্যন্ত বাড়তি মাশুল দিতে হচ্ছে।”
বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, “প্রতি ঘণ্টায় কনটেইনার খালাস হচ্ছে, কিন্তু সেই অনুপাতে খালাস না হওয়ায় চাপ বাড়ছে। শুল্কায়ন কার্যক্রম বন্ধ থাকায় ডেলিভারির গতি মারাত্মকভাবে কমে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে কয়েক দিনের মধ্যেই পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।”
চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের কোনো কর্মকর্তা এ বিষয়ে মন্তব্য করতে রাজি হননি।
প্রসঙ্গত, সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে নতুন করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেয়। এরই প্রতিবাদে ১৩ মে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি থেকে ১৪, ১৫, ১৭, ১৮ ও ১৯ মে পর্যন্ত কলম বিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ২০ মে আলোচনার আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও ২১ মে থেকে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ঘোষণা আসে। বর্তমানে এই কর্মসূচি চলছে এবং কবে নাগাদ সমাধান হবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
এই পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দরের পাশাপাশি দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি ও বাণিজ্যিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দ্রুত এই অচলাবস্থা নিরসন না হলে বিদেশি ক্রেতাদের আস্থা হারানোর পাশাপাশি রপ্তানি আদেশ বাতিল হওয়ার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে।
বাংলাবার্তা/এসজে