
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে নতুন রাজস্ব সংস্থা গঠনের প্রজ্ঞাপনের প্রতিবাদে পূর্বঘোষণা অনুযায়ী শনিবার দেশজুড়ে কলমবিরতি পালন করেছে এনবিআরের আওতাধীন আয়কর, ভ্যাট ও কাস্টমস কর্মকর্তারা। এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতৃত্বে পালিত এই কর্মসূচিতে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন কর অঞ্চল, কাস্টম হাউজ ও ভ্যাট কমিশনারেটে সেবামূলক কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ ছিল। রবিবারও দেশব্যাপী একইভাবে কলমবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি চলছে। কোথাও বাধা এলে তাৎক্ষণিক প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হবে।
শনিবার সকাল থেকেই রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অবস্থিত এনবিআর ভবনের সামনে বিপুলসংখ্যক রাজস্ব কর্মকর্তা ও কর্মচারী জড়ো হতে থাকেন। ব্যানার, প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে তারা অবস্থান ও প্রতিবাদ কর্মসূচি পালন করেন। স্লোগান দেন—“অভ্যন্তরীণ রাজস্ব ব্যবস্থার বিপরীতে ষড়যন্ত্র চলবে না”, “অধ্যাদেশ চাই না, স্বতন্ত্র রাজস্ব কমিশন চাই” ইত্যাদি।
রাজধানীর মতো চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, বরিশাল, সিলেট, ময়মনসিংহসহ দেশের সব বড় শহরে একইসঙ্গে কর অঞ্চল, ভ্যাট অফিস ও কাস্টম হাউজগুলোতেও একযোগে কর্মবিরতি পালন করা হয়। দুপুর পর্যন্ত এসব অফিসে কোনো ধরনের জনসেবা কার্যক্রম পরিচালিত হয়নি। তবে শুধু আন্তর্জাতিক যাত্রী চলাচল এবং রপ্তানিমুখী প্রক্রিয়া নির্বিঘ্ন রাখতে সীমিত পরিসরে কার্যক্রম চালু ছিল।
দুপুরের পর বিকেলে এনবিআর ভবনের সামনে আয়োজিত এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের নেতারা জানান, আন্দোলন চলমান থাকবে। বক্তব্য রাখেন কাস্টমসের অতিরিক্ত কমিশনার এদিপ বিল্লাহ, উপকর কমিশনার মোস্তফিজুর রহমান এবং সহকারী কর কমিশনার ইশতিয়াক হোসেন। তারা বলেন, দেশের স্বার্থে এবং রাজস্ব প্রশাসনের পেশাগত মর্যাদা রক্ষায় তাদের দাবিগুলো অত্যন্ত যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। এই দাবিগুলো দেশের অর্থনীতিবিদ, থিংক ট্যাংক ও বিভিন্ন পেশাজীবী মহল ইতোমধ্যে সমর্থন করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, রাজস্ব প্রশাসনে কাঠামোগত সংস্কারের প্রয়োজন রয়েছে—তবে তা হতে হবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মডেলের অনুসরণে এবং দেশের আর্থিক, সামাজিক বাস্তবতা ও প্রশাসনিক কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। বক্তারা অভিযোগ করেন, সরকার রাজস্ব খাতের এই অতীব গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার বিষয়ে এখনো সুনির্দিষ্ট ও অংশগ্রহণমূলক আলোচনা না করে একতরফাভাবে অধ্যাদেশ জারি করেছে, যা বাস্তব অর্থে এনবিআর বিলুপ্তির নামান্তর।
অন্যদিকে, আন্দোলনের কারণে এনবিআর ভবনজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতি নিয়ে আন্দোলনকারীদের মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়। সকাল থেকেই ভবনের ভেতরে ও বাইরে পুলিশ, র্যাব, বিজিবি এমনকি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের মোতায়েন করা হয়। আন্দোলনকারীরা এই ঘটনাকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অপচেষ্টা হিসেবে উল্লেখ করেন। তাদের ভাষায়, “আমরা সরকারি কর্মকর্তা—দাবি জানানো আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। কিন্তু এখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী দিয়ে সেই অধিকারকে দমন করার চেষ্টা চলছে।”
বক্তারা হুঁশিয়ার করে বলেন, রবিবারও দেশব্যাপী একইভাবে কলমবিরতি ও অবস্থান কর্মসূচি চলবে। কোথাও বাধা এলে তাৎক্ষণিক প্রেস ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে তা দেশবাসীর সামনে তুলে ধরা হবে।
তবে আন্দোলনের বিরুদ্ধে ভিন্নমতও রয়েছে রাজস্ব বিভাগের একটি অংশে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কর ও কাস্টমস ক্যাডারের কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা দাবি করেছেন, ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যে কর্মসূচি চলছে তা মূলত সরকারবিরোধী প্ল্যাটফর্মে রূপ নিচ্ছে।’ তাদের মতে, সরকার ইতোমধ্যে গেজেট প্রকাশের মাধ্যমে কাঙ্ক্ষিত অনেক সংস্কারের দিকনির্দেশনা দিয়েছে, বাকিগুলো সংশোধনীর মাধ্যমে বাস্তবায়ন সম্ভব।
তারা আরও বলেন, ‘একটি পক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে এনবিআর চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ এনে রাজস্ব প্রশাসনে স্থিতিশীলতা নষ্ট করতে চাইছে। বর্তমানে এনবিআরের উদ্যোগে ১৬ লাখের বেশি ট্যাক্সদাতা অনলাইনে রিটার্ন জমা দিয়েছেন, যার ফলে দুর্নীতির সুযোগ কমেছে। এই স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিবেশ অনেককে অস্বস্তিতে ফেলেছে।’
এসব কর্মকর্তারা অভিযোগ করেন, আন্দোলনের পেছনে একটি কুচক্রী মহল রয়েছে যারা নিজেরা দুর্নীতিতে জড়িত এবং এনবিআর চেয়ারম্যানের সাহসী ভূমিকা তাদের স্বার্থে আঘাত এনেছে। তারা বলেন, সরকার এই আন্দোলনকে সহ্য করবে না এবং প্রয়োজনে কঠোর পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবে।
সবশেষে বলা যায়, এনবিআরের কাঠামো নিয়ে চলমান এই উত্তেজনা রাজস্ব প্রশাসনের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় রচনা করেছে। যেখানে একদিকে রয়েছে আধুনিক ও স্বচ্ছতাভিত্তিক সংস্কারের প্রয়াস, অন্যদিকে রয়েছে অংশগ্রহণমূলক প্রক্রিয়া ও অধিকার নিশ্চিত না করার ক্ষোভ। এখন দেখার বিষয়, সরকার এই সঙ্কট কোন পথে সমাধানের চেষ্টা করে—আলোচনায়, নাকি দমনমূলক পন্থায়।
বাংলাবার্তা/এসজে