
ছবি: সংগৃহীত
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেছে জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। শনিবার (২৪ মে) রাত ৮টার দিকে রাজধানীর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন ‘যমুনা’-তে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে এনসিপির চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল অংশ নেয়। বৈঠক শেষে গণমাধ্যমের সামনে দলটির আহ্বায়ক মো. নাহিদ ইসলাম দলের পক্ষ থেকে উত্থাপিত পাঁচ দফা দাবি তুলে ধরেন।
নাহিদ ইসলাম জানান, দেশের চলমান রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংকট নিরসনে ড. ইউনূস যেভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং অন্তর্বর্তী সরকার পরিচালনা করছেন, তাতে তারা আস্থা রাখেন। এনসিপি মনে করে, বর্তমান অবস্থায় প্রধান উপদেষ্টা একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন এবং জনগণের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে তার যে অঙ্গীকার, সেটি পূরণ করেই তাকে পরবর্তী কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে নাহিদ বলেন, “ড. ইউনূসের প্রতি আমরা আমাদের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছি এবং বলেছি, তিনি যেন গণঅভ্যুত্থানের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করে তবেই নিজের অবস্থান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেন।”
বৈঠকে এনসিপি পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি উত্থাপন করেছে। প্রথমত, তারা দাবি করেছে—আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা সংক্রান্ত ‘জুলাই ঘোষণাপত্র’-এর প্রতিশ্রুতি যেন নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই বাস্তবায়ন করা হয়। দলটির মতে, আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে গণতান্ত্রিক কাঠামো ধ্বংস করে দেশে একদলীয় স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা মনে করে, এর যথার্থ বিচার এবং প্রতিকার হলো রাজনৈতিকভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা।
নাহিদ বলেন, “আমরা ড. ইউনূস স্যারকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছি যে, জুলাই আন্দোলনের সময় এই বিষয়ে যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল তা বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে ৩০ কার্যদিবস সময় চাওয়া হয়েছিল। এখন সেই সময়সীমা দ্রুত শেষ হয়ে আসছে, তাই বিষয়টি যেন আর কোনোভাবে বিলম্বিত না হয়।”
প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে আশ্বস্ত করা হয়েছে বলেও জানান তিনি। ড. ইউনূস নাকি বলেছেন, ঘোষিত সময়সীমার মধ্যেই জুলাই ঘোষণাপত্র প্রকাশ করা হবে।
দ্বিতীয় দাবিতে এনসিপি বলেছে, জুলাই আন্দোলনের সময় নিহত ও আহত হওয়া নেতাকর্মীদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর গতিতে চলছে। এই প্রক্রিয়াকে অবিলম্বে গতিশীল করতে হবে এবং নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে এর বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। এনসিপি দাবি করে, আন্দোলনে যারা জীবন দিয়েছেন বা পঙ্গু হয়েছেন, তারা দেশের গণতন্ত্র ও জনগণের অধিকার রক্ষায় আত্মত্যাগ করেছেন। সেই বিবেচনায় রাষ্ট্রের দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো।
তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসেবে এনসিপি জানিয়েছে, শেখ হাসিনার আমলে অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় সকল নির্বাচনকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবৈধ ঘোষণা করতে হবে। এনসিপির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, ওই সময়গুলোতে দেশে কোনো প্রকৃত গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছিল না এবং “দিনের ভোট রাতে হওয়ার” মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার হরণ করা হয়েছিল।
নাহিদ বলেন, “এসব নির্বাচন নিয়ে তখনকার বিরোধী দলগুলো একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করেছে। বর্তমানে আদালতে সেইসব নির্বাচনের বৈধতা নিয়ে বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করা হচ্ছে, যা নতুন করে রাজনৈতিক অস্থিরতা তৈরি করছে। এই সংকট নিরসনে প্রয়োজন, নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক অবৈধতা ঘোষণা।”
চতুর্থ দাবিতে এনসিপি বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থা প্রকাশ করেছে। দলটির ভাষ্য অনুযায়ী, এই কমিশন অতীত অভিজ্ঞতায় প্রমাণ করেছে তারা পক্ষপাতদুষ্ট ও অদক্ষ। তাই কমিশন পুনর্গঠন করে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক স্থানীয় সরকার নির্বাচন অবিলম্বে আয়োজনের দাবি জানায় তারা। এনসিপি মনে করে, গ্রাম পর্যায়ে গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে জাতীয় রাজনৈতিক কাঠামো কখনোই স্থায়ী ভিত্তি পাবে না।
সবশেষে এনসিপি যে দাবি জানায় তা হলো—জুলাই গণহত্যার বিচার এবং পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের একটি স্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা। নাহিদ বলেন, “জুলাইয়ের সেই রক্তাক্ত ঘটনার কোনো বিচার হয়নি। আমরা চাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি ট্রুথ কমিশন বা বিশেষ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে এই ঘটনার বিচার হোক। একইসঙ্গে পরবর্তী জাতীয় নির্বাচন কবে, কীভাবে, কোন কাঠামোতে অনুষ্ঠিত হবে তা স্পষ্টভাবে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে হবে।”
এই বৈঠকে এনসিপির প্রতিনিধি দলে ছিলেন দলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব এবং সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা। তারা সবাই প্রধানমন্ত্রী ইউনূসের সামনে দেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রশাসনিক দুর্বলতা তুলে ধরেন।
নাহিদ জানান, ড. ইউনূস তাঁদের বক্তব্য মনোযোগ দিয়ে শুনেছেন এবং প্রতিটি দাবির ব্যাপারে সরকারিভাবে যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
এই বৈঠকের খবর ছড়িয়ে পড়তেই রাজনৈতিক মহলে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি এবং আগের সব নির্বাচনের বৈধতা বাতিলের প্রস্তাবকে অনেকে একটি বড় রাজনৈতিক রূপরেখার অংশ হিসেবে দেখছেন। অন্যদিকে বিশ্লেষকরা বলছেন, যদি ড. ইউনূস এই দাবিগুলোকে সামনে রেখে বাস্তব কিছু পদক্ষেপ নেন, তাহলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি নতুন অধ্যায় সূচিত হতে পারে।
তবে বিরোধীদলের একাংশ মনে করে, এনসিপির এই পদক্ষেপ দেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য সহায়ক হবে যদি তা বাস্তবায়ন পর্যন্ত যায় এবং শুধুমাত্র কাগজে-কলমে সীমাবদ্ধ না থাকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ