
ছবি: সংগৃহীত
অবরুদ্ধ গাজায় ত্রাণ সংগ্রহ করতে আসা ক্ষুধার্ত ফিলিস্তিনিদের ওপর আবারও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। দক্ষিণ গাজার উপকূলীয় এলাকা আল-মাওয়াসিতে শনিবার দুপুর ২টার দিকে ত্রাণবাহী একটি ট্রাকের সামনে জড়ো হয় অসংখ্য ফিলিস্তিনি নাগরিক—যাদের অধিকাংশই দিন পার করছেন অনাহারে, চরম খাদ্যসংকটে। ঠিক সেই মুহূর্তে, কোনো ধরনের সতর্কতা ছাড়াই ওই ভিড় লক্ষ্য করে হামলা চালায় ইসরায়েলি সেনারা। এতে অন্তত পাঁচজন ফিলিস্তিনি নিহত হন এবং আহত হন আরও পঞ্চাশজন।
এই হামলার খবর নিশ্চিত করেছে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। রয়টার্স জানায়, গত তিনদিনে মাত্র ১১৯টি ত্রাণবাহী ট্রাক গাজায় প্রবেশ করেছে। যেখানে প্রতিদিনের ন্যূনতম চাহিদা ৫০০ থেকে ৬০০ ট্রাক—এ ধরনের সংকটপূর্ণ পরিস্থিতিতে প্রতিটি ট্রাকই যেন জীবন বাঁচানোর শেষ আশ্রয়। অথচ সেই আশ্রয়স্থলেই আঘাত হানে সামরিক শক্তি।
এই একই দিনে গাজার বিভিন্ন স্থানে চালানো বিচ্ছিন্ন বিমান ও ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন আরও ২৮ জন ফিলিস্তিনি। এর মধ্যে পূর্ব গাজা শহরে ড্রোন হামলায় নিহত হন চারজন। গাজা শহরের আল-তুফাহ পাড়ায় এক বিমান হামলায় একই পরিবারের তিন নারী এবং একটি শিশু নিহত হয়। খান ইউনিসের উত্তরে আল-শরিফ পরিবারের ওপর চালানো ড্রোন হামলায় নিহত হন আরও ছয়জন।
গাজা শহরের আল-আমাল পাড়ায় ‘আল-মাধৌন’ পরিবারের চার সদস্য এবং নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে ‘জৌদা’ পরিবারের দুইজন নিহত হন পৃথক হামলায়। এদিকে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর দাবি, তাদের হামলার লক্ষ্য ছিল হামাসের টানেল, অস্ত্রাগার এবং যোগাযোগ অবকাঠামো। শুক্রবার ইসরায়েল গাজায় একদিনেই ১০০টিরও বেশি স্থানে জেট বিমান হামলা চালায়।
তবে মানবিক পরিস্থিতির বিবেচনায় এই হামলাগুলো এখন আন্তর্জাতিক মহলে ‘গণহত্যার শামিল’ বলে সমালোচিত হচ্ছে। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের উপ-নির্বাহী পরিচালক টেড চাইবান নিরাপত্তা পরিষদের সাম্প্রতিক এক বৈঠকে বলেন, গাজার ৭০ শতাংশ পানি ও স্যানিটেশন অবকাঠামো এখন সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস বা অকেজো হয়ে গেছে। যার ফলে অন্তত ৭৫ শতাংশ পরিবারের কাছে পর্যাপ্ত পানি নেই।
গাজা এখন এক খোলা কারাগারে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যুর আশঙ্কায় জীবন কাটাচ্ছে প্রায় ২৩ লাখ মানুষ। চলমান যুদ্ধের কারণে ধ্বংস হয়ে গেছে হাসপাতাল, স্কুল, মসজিদ এমনকি জাতিসংঘ পরিচালিত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোও।
সবচেয়ে ভয়াবহ তথ্য উঠে এসেছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ প্রতিবেদন থেকে। ৭ অক্টোবর ২০২৩ থেকে শুরু হয়ে ২০২৫ সালের মে মাস পর্যন্ত—১৯ মাসেরও বেশি সময় ধরে চলমান ইসরায়েলি অভিযানে এখন পর্যন্ত নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৫৩ হাজার ৯০১ জন। আহত হয়েছেন ১ লাখ ২২ হাজার ৫৯৩ জন। এক দিনে মারা গেছেন অন্তত ৭৬ জন। উল্লেখযোগ্য সংখ্যক হতাহত ঘটেছে উত্তর গাজার হাসপাতালগুলোতে, যেগুলোতে এখন কার্যত কোনো চিকিৎসা সুবিধাই নেই।
এদিকে গাজার উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত হাসপাতাল ও সেবাকেন্দ্রগুলোয় প্রবেশ করতে না পারায় অনেক মানুষ সেখানে সহায়তা পাচ্ছেন না। চিকিৎসাসেবা ও জরুরি খাদ্য থেকে বঞ্চিত এসব মানুষ এখন ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মারা যাচ্ছেন, অথবা ক্ষুধা ও পানির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে জীবন হারাচ্ছেন।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদের মুখেও ইসরায়েলি আগ্রাসন বন্ধ হওয়ার কোনো ইঙ্গিত নেই। বরং তারা হামলার মাত্রা আরও বাড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো, জাতিসংঘ ও মুসলিম বিশ্বের নেতারা গাজার জনগণের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে দ্রুত যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন।
তবে বাস্তবতা হলো—গাজা এখন আর কেবল যুদ্ধবিধ্বস্ত এক অঞ্চল নয়, এটি হয়ে উঠেছে মানব সভ্যতার ব্যর্থতার এক কলঙ্কিত প্রতীক, যেখানে প্রতিদিন শত শত নিরীহ নারী, শিশু ও বৃদ্ধ নিহত হচ্ছে খাদ্যের আশায়, চিকিৎসার আশায়, জীবনের আশায় দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ