
ছবি: সংগৃহীত
দেশে প্রচুর পরিত্যক্ত ও অপ্রয়োজনীয় এয়ারফিল্ড থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এখনও রাজধানীর জনবহুল ঢাকা অঞ্চলে চালানো হচ্ছে। মিরপুর, উত্তরা, তেজগাঁওসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিয়মিত প্রশিক্ষণরত যুদ্ধবিমান উড়ে বেড়ায়, যা সাধারণ মানুষের নিরাপত্তার জন্য বড় ঝুঁকি সৃষ্টি করছে। বিষয়টি নিয়ে এভিয়েশন বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। প্রশ্ন উঠেছে, এত পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড থাকা অবস্থায় ঢাকার ভেতরে কেন যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে?
ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে সামরিক যুদ্ধবিমান ও বাণিজ্যিক যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ উভয়ই একই রানওয়েতে উড্ডয়ন ও অবতরণ করে থাকে। এটি বিশ্বের অতি বিরল একটি ঘটনা। বেশিরভাগ দেশের বিমানবন্দরেই বাণিজ্যিক এবং সামরিক বিমান চলাচলের জন্য পৃথক পৃথক রানওয়ে বা বিমানবন্দর রয়েছে।
আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশন (আইকাও) এবং বেবিচকের নিজস্ব নিয়মে প্রশিক্ষণ ফ্লাইট জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পরিচালনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। আইকাও নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রশিক্ষণ ফ্লাইটগুলো এমন এলাকায় চালানো উচিত যেখানে জনবসতি কম এবং ঝুঁকি সর্বনিম্ন। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ঢাকার মতো জনবহুল এলাকায় যুদ্ধবিমানের নিয়মিত প্রশিক্ষণ পরিচালিত হচ্ছে।
দেশে পরিত্যক্ত ও অপ্রয়োজনীয় ছয়টি এয়ারফিল্ড
দেশে এখনও কমপক্ষে ছয়টি পুরাতন ও পরিত্যক্ত এয়ারফিল্ড রয়েছে, যা সামরিক প্রশিক্ষণের জন্য যথেষ্ট উপযোগী। কিন্তু সেগুলো কার্যকরভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না।
ঈশ্বরদী এয়ারফিল্ড: পাবনা-নাটোর সীমান্তে অবস্থিত, একসময় বাণিজ্যিক ফ্লাইট চলাচল করত। বর্তমানে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনী সীমিতভাবে ব্যবহার করে। রানওয়ের দৈর্ঘ্য প্রায় ৪ হাজার ৭০০ ফুট। তবে যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে কার্যক্রম সীমিত।
ঠাকুরগাঁও এয়ারফিল্ড: ১৯৮০ সালে পরিত্যক্ত ঘোষিত, ১৯৭১ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পর সংস্কার হয়নি। প্রশিক্ষণ ব্যবহারের জন্য সম্ভাবনা রয়েছে।
কুমিল্লা এয়ারস্ট্রিপ: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় তৈরি, একসময় বাণিজ্যিক ও সামরিক উড়োজাহাজ চলাচল করত। ১৯৮৬ সালের পর বন্ধ।
লালমনিরহাট বিমানবন্দর: একসময় এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানঘাঁটি। বর্তমানে সীমিত কার্যক্রম, ফাইটার বা প্রশিক্ষণ বিমানের ব্যবহার নেই।
টাঙ্গাইল এয়ারস্ট্রিপ: সীমিতভাবে বিমানবাহিনীর প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার হচ্ছে।
ফেনী এয়ারফিল্ড: দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আমেরিকান বেজ, বর্তমানে পরিত্যক্ত, কিছু অংশে স্থাপত্য কাজ হয়েছে।
বিমান নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাজী ওয়াহিদুল আলম বলেন, “ঢাকায় এত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এয়ারপোর্ট থাকা উচিত নয়। আমরা আইকোর নিয়মকানুন মানছি না। ঢাকার চারপাশ উঁচু ভবন আর জনবসতিতে ঘেরা। এটা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।”
তিনি আরও বলেন, “স্বাধীনতার পর থেকে আমাদের নতুন কোনো বিমানবন্দর হয়নি। পুরোনোগুলোও পরিত্যক্ত হয়ে পড়েছে। এগুলো সক্রিয় করেই প্রশিক্ষণ আয়োজন করা যেতে পারে।”
বিমান প্রশিক্ষণ বিষয়ক বিশেষজ্ঞ, অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “ঢাকা শহর খুবই জনবহুল। এখানে যুদ্ধবিমান প্রশিক্ষণ চালানো নিরাপদ নয়। ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে প্রশিক্ষণের স্থান নতুন করে নির্ধারণ করা দরকার। অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ হয় টেকনিক্যাল সমস্যা বা পাইলটের ভুল।”
বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী, যুদ্ধবিমানের প্রশিক্ষণ জনবসতিপূর্ণ এলাকায় দেয়া উচিত নয়। ঢাকাসহ জনবহুল এলাকায় প্রশিক্ষণ চালানোর ফলে সম্ভাব্য দুর্ঘটনার ঝুঁকি বহুগুণ বেড়ে যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, দেশের বিদ্যমান পরিত্যক্ত ও অপ্রয়োজনীয় এয়ারফিল্ডগুলো আধুনিকায়ন করে প্রশিক্ষণের জন্য ব্যবহার করলেই নিরাপত্তা বৃদ্ধি পাবে এবং জনজীবন ঝুঁকিমুক্ত থাকবে।
তারা সরকারের কাছে দাবি জানাচ্ছেন, দ্রুত কূটনৈতিক ও প্রশাসনিক উদ্যোগ নিয়ে দেশের সামরিক বিমান প্রশিক্ষণ কার্যক্রমের স্থানান্তর করতে হবে। যাতে জনজীবন ও নিরাপত্তা নিশ্চিতে এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ