
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘদিনের অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে সরকারি চাকরিজীবীদের নতুন বেতন কাঠামো নির্ধারণে একটি পূর্ণাঙ্গ পে কমিশন গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরবর্তীতে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে এক প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।
সাবেক অর্থসচিব জাকির আহমেদ খানকে এ পে কমিশনের প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সরকারি প্রশাসনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই কর্মকর্তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব ছিলেন এবং তার আর্থিক প্রশাসন, বাজেট প্রণয়ন এবং জনশক্তি কাঠামো বিশ্লেষণে রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান। এবার তার ওপরই বর্তেছে প্রায় ১৫ লাখ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বেতন কাঠামোর পূর্ণ পর্যালোচনা ও হালনাগাদ প্রস্তাব তৈরির দায়িত্ব।
বর্তমানে সরকারি কর্মচারীরা ২০১৫ সালের জাতীয় বেতন স্কেল অনুযায়ী বেতন-ভাতা পান। প্রায় এক দশক আগে ঘোষিত এই স্কেলকে বর্তমান সময়ের উচ্চ মূল্যস্ফীতির প্রেক্ষাপটে অনেকটাই অপ্রতুল মনে করা হচ্ছে। গত দুই বছরের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ক্রমাগত উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে নাগরিকদের প্রকৃত আয় কমে এসেছে। বিশেষ করে খাদ্যপণ্য, বাসস্থান, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মধ্য ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির সরকারি কর্মীদের জীবনযাত্রা চাপে পড়েছে।
২০২৪ সালের নভেম্বর থেকে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য মহার্ঘ ভাতা চালুর বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। এ বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মহার্ঘ ভাতা চালুর প্রস্তুতিও নেওয়া হয়। তবে পরবর্তীকালে বিভিন্ন মহলের সমালোচনা এবং বাজেটের বাস্তবায়ন জটিলতার কারণে সরকার পিছিয়ে আসে। অনেকেই অভিযোগ করেন, এই ভাতা প্রদান রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হতে পারে, এমন ধারণা থেকে এটি স্থগিত রাখা হয়।
তবে সরকার তখনই ঘোষণা দিয়েছিল, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের স্বার্থ বিবেচনায় একটি পূর্ণাঙ্গ সমাধানের দিকেই এগোবে তারা। সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই এবার গঠিত হলো নতুন পে কমিশন।
সরকারি কর্মচারীদের জন্য চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে বরাদ্দেও দেখা যাচ্ছে ইতিবাচক পরিবর্তন। এ বছর সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ১৩ হাজার ৪৮৩ কোটি টাকা এবং কর্মচারীদের জন্য বরাদ্দ ৩০ হাজার ৪৮ কোটি টাকা। এছাড়া ভাতা বাবদ বরাদ্দ ধরা হয়েছে ৪১ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে বেতন ও ভাতা খাতে মোট ৮৪ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
তুলনামূলকভাবে দেখতে গেলে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের মূল বাজেটে এই খাতে বরাদ্দ ছিল ৮২ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা। সেই হিসেবে বরাদ্দ বেড়েছে ১ হাজার ৭০৭ কোটি টাকা। এ থেকে স্পষ্ট, সরকার আগামী দিনের কাঠামোতে জনশক্তি খাতে অধিক গুরুত্ব দিচ্ছে।
পে কমিশনের দায়িত্ব হবে সামগ্রিকভাবে সরকারি বেতন কাঠামো বিশ্লেষণ করে একটি যুগোপযোগী প্রস্তাবনা তৈরি করা, যেখানে শুধু মূল বেতন নয়—গ্রেড, ইনক্রিমেন্ট কাঠামো, ভাতা, অবসর সুবিধা, পেনশন ও কর্মক্ষমতা মূল্যায়নের মতো বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনা হবে।
এ ছাড়া কমিশনকে বর্তমান মূল্যস্ফীতির হার, জীবনযাত্রার ব্যয়, আর্থিক সক্ষমতা ও প্রতিবেশী দেশগুলোর সরকারি বেতন কাঠামোর তুলনামূলক বিশ্লেষণ করতে হবে।
পে কমিশনকে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে সময়সীমা জানানো হয়নি, তবে ধারণা করা হচ্ছে, আগামী ছয় মাসের মধ্যে তারা একটি প্রাথমিক প্রতিবেদন সরকারের কাছে জমা দেবে।
সরকারি চাকরিজীবীদের সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ, যাদের পরিবারসহ প্রায় ৬০ লাখ মানুষের জীবনজীবিকা এই কাঠামোর ওপর নির্ভর করে। নতুন বেতন কাঠামো শুধু সরকারি কর্মচারীদের অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে না, বরং সামগ্রিক বাজার ব্যবস্থাতেও প্রভাব ফেলবে। বাড়তি ক্রয়ক্ষমতা অভ্যন্তরীণ বাজারে চাহিদা বাড়াবে, যা অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখতে পারে।
অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, “সরকারি চাকরিজীবীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন ছাড়া টেকসই প্রশাসনিক কাঠামো গঠন সম্ভব নয়। এ পে কমিশনের মাধ্যমে আমরা একটি দীর্ঘমেয়াদি ও অর্থনৈতিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ কাঠামো পেতে চাই।”
সরকারের এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রশাসনিক কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা আশা করছেন, এই পে কমিশন বাস্তবধর্মী ও সময়োপযোগী একটি কাঠামো প্রণয়ন করবে, যা কেবল বেতন বৃদ্ধি নয়, বরং কর্মপ্রেরণা, দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশাসনিক গতিশীলতায় অবদান রাখবে।
নতুন পে কমিশনের কাজ শুরু হলে আগামী মাসগুলোতে এ সংক্রান্ত আরো তথ্য, মতামত ও প্রস্তাব নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকবে সরকারি বেতন কাঠামো।
বাংলাবার্তা/এমএইচ