
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের রপ্তানি ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) বাজারে গত পাঁচ মাসে উল্লেখযোগ্য উন্নতি দেখিয়েছে। ২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত এই বাজারে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি ১৭.৬১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৯.৬৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছেছে। ২০২৪ সালের একই সময়ে রপ্তানি ছিল ৮.২৩ বিলিয়ন ডলার। এ উন্নতি দেশের রপ্তানি খাতের জন্য এক আশাব্যঞ্জক সংকেত হিসেবে ধরা হচ্ছে, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন শুল্ক আরোপের চাপে পড়ার প্রেক্ষাপটে।
তবে, মে মাসে ইইউর বাজারে পোশাক রপ্তানি কিছুটা হ্রাস পেয়েছে। ওই মাসে ৬.৪৬ শতাংশ কমে রপ্তানি দাঁড়িয়েছে ১.৬১ বিলিয়ন ডলারে। এই পতন কিছুটা অস্থায়ী হিসেবে দেখা হচ্ছে, কারণ অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোর পারফরম্যান্সও মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে একই প্রবণতা।
বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী দেশ তুরস্কও মে মাসে ৮.৩০ শতাংশ রপ্তানি হ্রাসের মুখোমুখি হয়েছে। তারা ৭৭০ মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি করেছে। অন্যদিকে, ভিয়েতনাম ইউরোপীয় বাজারে ১৫.৬৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন করে ৩৫০ মিলিয়ন ডলার মূল্যের পোশাক রপ্তানি করেছে।
ইউরোস্ট্যাটের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারি-মে মাসে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিশ্বব্যাপী পোশাক আমদানির পরিমাণ ১১.৯০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৩৯.৭১ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। তবে সামগ্রিক দামে ১.৩৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশের রপ্তানি বৃদ্ধিতে ১৫.০৮ শতাংশ পরিমাণ বৃদ্ধি এবং ২.২০ শতাংশ দামের বৃদ্ধি হয়েছে, যা ইইউর বাজারে বাংলাদেশের পোশাক খাতের স্থিতিশীল ও ভারসাম্যপূর্ণ অগ্রগতির প্রতিফলন। এর পাশাপাশি চীন, ভারত, পাকিস্তান, কম্বোডিয়া ও ভিয়েতনামসহ অন্যান্য প্রধান রপ্তানিকারক দেশগুলোর মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে।
বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, “ইইউর বাজারে বাংলাদেশের অবস্থান শক্তিশালী হলেও যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক নীতি কঠোর হওয়ার কারণে বৈচিত্র্যময় বাজার অনুসন্ধান অত্যন্ত জরুরি। আমাদের পুরোপুরি নির্ভরশীলতা কমিয়ে নতুন ও উদ্ভাবনী বাজারে প্রবেশের উদ্যোগ নিতে হবে।”
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে নতুন শুল্কহার আরোপ বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ, তাই ইইউর বাজারে অর্জিত এই ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তবে দীর্ঘমেয়াদে টেকসই উৎপাদন, শ্রমিক অধিকার ও পরিবেশগত দায়িত্ব পালন ইইউর শর্ত হিসেবে বিবেচিত হওয়ায় এ ক্ষেত্রে গুরুত্বারোপ করা প্রয়োজন।”
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাংলাদেশের জন্য শুধুমাত্র প্রচলিত পোশাক পণ্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে ভ্যালু অ্যাডেড বা মূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে মনোযোগ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে শ্রমিক অধিকার, পরিবেশবান্ধব উৎপাদন পদ্ধতি ও বাজার বৈচিত্র্যকরণের মাধ্যমে ইউরোপীয় বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান ধরে রাখা জরুরি।
বিশ্ববাজারে পোশাক শিল্পের এ পরিবর্তনশীল পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক থাকতে চাইছে, তেমনি আগামী ১ আগস্ট থেকে যুক্তরাষ্ট্রে ৩৫ শতাংশ ‘রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ বা পাল্টা শুল্ক কার্যকর হওয়ার প্রেক্ষাপটেও বাংলাদেশকে দ্রুত প্রস্তুতি নিতে হবে।
মহিউদ্দিন রুবেল আরও বলেন, “বর্তমানে মোট রপ্তানির প্রায় অর্ধেক ইউরোপীয় বাজারের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় এ বাজারে ধারাবাহিক উন্নয়নের জন্য যথাযথ নীতিমালা এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য।”
ড. জাহিদ হোসেন যোগ করেন, “বাজার বৈচিত্র্যকরণ ও উদ্ভাবনী পণ্যের মাধ্যমে রপ্তানি বর্ধিত করার পাশাপাশি পরিবেশগত ও সামাজিক দায়িত্ব পালনে বিনিয়োগ বৃদ্ধির মাধ্যমে আমরা দীর্ঘমেয়াদী টেকসই প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারব।”
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশের তৈরি পোশাক রপ্তানিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার আয় বৃদ্ধি ও অর্থনীতির উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। তবে এই সাফল্য ধরে রাখতে শ্রম অধিকার, পরিবেশ সুরক্ষা ও নতুন বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্রে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া অপরিহার্য বলে বিশেষজ্ঞরা মত প্রকাশ করছেন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ