
ছবি: সংগৃহীত
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই প্রযুক্তির দ্রুত প্রসার অনেক ক্ষেত্রেই জীবনকে সহজতর করলেও, বাংলাদেশে এর অপব্যবহার ব্যাপকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, নারীনেত্রী, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন শ্রেণির মানুষদের বিরুদ্ধে ভুয়া ছবি, ভিডিও ও অপতথ্য ছড়ানোর ক্ষেত্রে এআই এখন এক ভয়ঙ্কর অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের ডিজিটাল লিটারেসি অপ্রতুলতা এবং আইনগত শূন্যতার কারণে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে এবং এর প্রভাব আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।
নারীদের প্রতি ডিজিটাল সহিংসতা ও এআই প্রযুক্তি
এআই প্রযুক্তির অপব্যবহারে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন নারীরা। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে তৈরি করা নোংরা, বিভ্রান্তিকর ও শ্লীলতাহানিমূলক কনটেন্ট নারী নেত্রীদের রাজনৈতিক কর্মসূচি ব্যাহত করছে, একই সঙ্গে তাদের মানসিক ও সামাজিক নিরাপত্তায় বড় ধাক্কা দিয়েছে। একশনএইড বাংলাদেশের জরিপে দেখা গেছে, ৬৪ শতাংশ নারী অনলাইনে এ ধরনের হয়রানির শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে প্রায় ৭০ শতাংশই শ্লীলতাহানিমূলক ভিডিও ও ছবি। এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে তৈরি এসব কনটেন্ট শুধু ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিঘ্নিত করছে না, বরং রাজনৈতিক ক্ষমতা সংক্রান্ত অস্থিরতা ও বিভাজনও গভীর করছে।
জাতীয় শোকের সময় বিভ্রান্তি ছড়ানোর ভয়াবহতা
গত ২১ জুলাই ঢাকার উত্তরায় মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হওয়ার ঘটনায় দেশবাসী শোকাহত হলেও, সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই দিয়ে তৈরি বিভ্রান্তিকর ও ভুয়া ভিডিও দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। ফ্যাক্ট-চেকিং সংস্থা রিউমার স্ক্যানার এসব ভিডিও গুগলের ভিইও-এআই টুল দিয়ে তৈরি কল্পিত দৃশ্য হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এই ভিডিওগুলোতে মাইলস্টোনের বানান ভুল, ভবনের গঠন অমিল ছিল এবং অনেক ভুল তথ্য পরিবেশন করা হয়। জাতীয় শোকের মুহূর্তে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার জনমনে বিভ্রান্তি ছড়ানো কতটা বিপজ্জনক হতে পারে, তার একটি স্পষ্ট উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এটি।
প্রশাসনিক ও আইনি তৎপরতার অভাব
সরকারি পর্যায়ে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে এখনও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। তথ্য ও প্রযুক্তি বিভাগের বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, ‘সাইবার সিকিউরিটি অ্যাক্টে এআই অপব্যবহার রোধের নির্দেশনা আছে, তবে বাস্তবে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের ডিজিটাল লিটারেসি কম থাকায় এআই দ্বারা সৃষ্ট মিথ্যা কনটেন্ট সহজে বিশ্বাস করা হচ্ছে, যা নিয়ন্ত্রণ কঠিন করে তুলছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘উন্নত বিশ্ব যেখানে এআই অপব্যবহার রোধে বিভিন্ন টেকনোলজিক্যাল ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা নিচ্ছে, আমাদেরও ভিজিল্যান্স টিম গঠন এবং পলিসি মেকারদের সক্রিয় ভূমিকা নেয়া উচিত। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবে।’
লন্ডনভিত্তিক প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ শামীম সরকার বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এআই অপব্যবহার বেড়ে চলেছে। বিশেষ করে নারীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল সহিংসতা ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়ছে। আইনি নীতিমালা, ফ্যাক্ট-চেকিং প্ল্যাটফর্ম ও মিডিয়া লিটারেসি বাড়ানো ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়।’
সোশ্যাল মিডিয়ায় এআই সৃষ্ট ভুয়া তথ্যের বিস্তার
সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, মেটা, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রামসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মের ৮০ শতাংশ পোস্টই এআই রিকমেন্ডেশনের মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে। বিগত ছয় মাসে সোশ্যাল মিডিয়ায় ভুল তথ্য ছড়ানোর হার প্রায় ২০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের বিরুদ্ধে কল্পিত তথ্য প্রচার এবং সামাজিক বিভাজন আরও তীব্র হচ্ছে।
ডিপফেক, সিন্থেটিক ভিডিও ও ভয়েস ক্লোনিং টেকনোলজির সহজলভ্যতায় সাধারণ মানুষ এখন এআই ব্যবহার করে বাস্তবের মতো কনটেন্ট তৈরি করতে পারছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের কনটেন্টের মাধ্যমে ডিজিটাল সহিংসতা ও অপপ্রচার কয়েকশ গুণ বৃদ্ধি পাবে বলে প্রযুক্তিবিদরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
আইন ও নীতিমালা: শূন্যতা ও প্রয়োজনীয়তা
বর্তমানে বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ আইন বা গাইডলাইন নেই। তথ্য প্রযুক্তি বিভাগ ও নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়নি। প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, এআই-চালিত ভুয়া কনটেন্টকে অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে ডিপফেক শনাক্তকরণের জন্য উন্নত টুলস চালু করতে হবে। পাশাপাশি মনিটরিং টিম গঠন করে সোশ্যাল মিডিয়ায় কনটেন্ট নজরদারি করতে হবে।
অধ্যাপক মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘মনিটরিং না করলে অপতথ্য ছড়ানো বন্ধ হবে না। নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই সুরক্ষা দিতে হবে এবং জনবল নিয়োগ করে পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা চালু করতে হবে।’
শামীম সরকার বলেন, ‘দেশে ফেসবুক, এক্স, ইউটিউবের মতো প্ল্যাটফর্মগুলোতে এআই কনটেন্টের ব্যাপকতা থাকা সত্ত্বেও রিমুভাল বা রেস্ট্রিকশন পর্যাপ্ত নয়। এ বিষয়ে সরাসরি প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সরকারিভাবে আলোচনা প্রয়োজন।’
ভবিষ্যৎ দৃষ্টিভঙ্গি ও করণীয়
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এআই প্রযুক্তির ইতিবাচক দিক যেমন আছে, তেমনি এর অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে মাল্টিডাইমেনশনাল পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি। এর মধ্যে রয়েছে:
আইনগত প্রণয়ন ও কঠোর বাস্তবায়ন
উন্নত তথ্য যাচাই ও ডিপফেক শনাক্তকরণ প্রযুক্তি প্রয়োগ
প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞদের অন্তর্ভুক্তি ও পর্যবেক্ষণ টিম গঠন
জনগণের ডিজিটাল লিটারেসি ও মিডিয়া সচেতনতা বৃদ্ধির উদ্যোগ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় ও কার্যকর নিয়ন্ত্রণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগের একজন অধ্যাপক মন্তব্য করেছেন, ‘নির্বাচনের আগে এআই সৃষ্ট অপতথ্য বৃদ্ধির ফলে দেশ কঠিন সময়ের মুখোমুখি হবে। এখনই সক্রিয় পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে না।’
সামগ্রিকভাবে দেখা যাচ্ছে, বাংলাদেশে এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার ক্রমশ ভয়াবহ আকার ধারণ করছে, যা সামাজিক স্থিতিশীলতা, রাজনৈতিক প্রক্রিয়া এবং মানবাধিকারকে বিপদে ফেলছে। প্রযুক্তির এ মন্দ প্রভাব থেকে মুক্তি পেতে সরকারের ত্বরিত পদক্ষেপ ও ব্যাপক জনসচেতনতা ছাড়া বিকল্প নেই। নয়তো আসন্ন জাতীয় নির্বাচনসহ দেশের ভবিষ্যৎ গঠন প্রভাবিত হবে এবং ডিজিটাল জগতে একটি ভয়াবহ সংকট সৃষ্টির আশঙ্কা বেড়ে যাবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ