
ছবি: সংগৃহীত
চলচ্চিত্র ও টেলিভিশনের জনপ্রিয় মুখ আজমেরী হক বাঁধন বরাবরই নিজের অবস্থান স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। তিনি শুধু অভিনয় নয়, ব্যক্তি-স্বাধীনতা, নারীর অধিকার, এবং সমাজের গড়পড়তা দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে বারবার নিজের মতামত ব্যক্ত করেছেন। সম্প্রতি সামাজিক মাধ্যমে দেওয়া এক দীর্ঘ, আবেগঘন পোস্টে বাঁধন নিজের পোশাক নির্বাচন, অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতা, এবং নিজের স্বাধীনতা নিয়ে অকপটে কথা বলেন।
এই লেখায় স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে, কীভাবে সমাজের চাপ ও রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি একজন নারীর জীবনকে প্রভাবিত করতে পারে, এবং সেই চাপ থেকে বের হয়ে নিজেকে খুঁজে পাওয়ার সংগ্রাম কতটা কঠিন হতে পারে। বাঁধনের ভাষ্যে উঠে এসেছে সেই ভাঙাগড়ার গল্প, যেখানে একজন নারী নিজের পছন্দকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কী পরিমাণ সামাজিক চাপ ও অবহেলার মুখোমুখি হন।
পোস্টের শুরুতেই বাঁধন বলেন, “একটা সময় আমিও একটা সুন্দর, সাধারণ মেয়ে ছিলাম। এমন পোশাক পরতাম যা সমাজ ও পরিবার প্রত্যাশা করত।” তিনি উল্লেখ করেন, ছোটবেলায় বাবা-মায়ের পছন্দকে প্রাধান্য দিয়েই চলতেন, কখনো জিন্স পরতেন না। কারণ সমাজের প্রচলিত ধারণা ছিল— “জিন্স খারাপ মেয়েরা পরে”।
সে সময় তিনি ভেবেছিলেন, সমাজের চোখে 'পারফেক্ট মেয়ে' হতে পারলে সম্মান পাবেন, নিজের জন্য ভালো কিছু গড়ে তুলতে পারবেন। তাই সমাজের প্রত্যাশিত রূপে নিজেকে গড়ে তোলার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু সেই ‘পারফেক্ট’ হওয়ার চেষ্টা বেশিদূর এগোয়নি। বাঁধন অকপটে জানান, “আমার পৃথিবীটাই ভেঙে পড়ে যখন আমি এক ট্রমাটিক সংসার জীবন থেকে মুক্তি চাই।” সেই সময় তাকে রিহ্যাবে যেতে হয়, মানসিকভাবে নিজেকে সামলাতে হিমশিম খেতে হয়।
এরপর জীবনের মোড় ঘুরে যায় ২০০৬ সালে, লাক্স-চ্যানেল আই সুপারস্টার প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার মধ্য দিয়ে। বাঁধন জানান, “সেই প্রতিযোগিতাই আমাকে নিজের ভেতরের শক্তিকে খুঁজে পেতে সাহায্য করে। শুধু একজন নারী নয়, একজন মানুষ হিসেবেও নিজেকে খুঁজে পাই।”
তবে মনের এই পরিবর্তন মানেই সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টেছে—তা নয়। বরং বাঁধন জানান, “আমি জিন্স পরতাম, এমন পোশাক পরতাম যেখানে ত্বক দেখা যেত। যা সমাজের চোখে ভালো মেয়েদের জন্য উপযুক্ত নয়।”
দ্বিতীয়বার বিবাহবিচ্ছেদের পর সমাজ তাকে ‘ব্যর্থ নারী’ এবং ‘খারাপ মেয়ে’ হিসেবে চিহ্নিত করতে থাকে। এই মানসিক অবহেলা এবং অবজ্ঞা তাকে ভীষণভাবে আঘাত করে। তবে এখানেই তিনি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করেন। নিজের অধিকারের জন্য লড়াই শুরু করেন, নিজের মত প্রকাশ করতে শেখেন।
এক ঘটনা স্মরণ করে বাঁধন লেখেন, “একদিন এক বন্ধু ফোন করে বলল—‘তুমি এত সুন্দর কাজ করছ, কথা বলো— কিন্তু আরেকটু ঢেকে পোশাক পরা উচিত তোমার।’ আমি শুধু হেসেছিলাম।”
আরেকটি টেলিভিশন সাক্ষাৎকারের অভিজ্ঞতায় তিনি জানান, স্লিভলেস ব্লাউজ পরায় তাকে বলা হয় কাঁধ ঢেকে রাখতে, চুল দিয়ে ঢেকে দিতে। এমনকি তাকে দেওয়া হয় ‘লেকচার’ কীভাবে একজন মা, ‘বুদ্ধিমতী নারী’ কিংবা রক্ষণশীল পরিবারের সদস্য হিসেবে চলাফেরা করা উচিত।
এইসব অভিজ্ঞতার কথা বলার পর বাঁধন লেখেন, “জানেন কী? এখন এসব আমি একটুও পরোয়া করি না। আমি এখন স্বাধীন। কী পরব, কীভাবে জীবন কাটাবো— সেটা একান্তই আমার সিদ্ধান্ত।”
তিনি স্পষ্ট করে বলেন, কারও নেই অধিকার তাকে বলে দেওয়ার, তিনি কী পরবেন, কী বলবেন, কিংবা কেমন জীবন যাপন করবেন। এভাবেই তিনি নিজের অবস্থানকে তুলে ধরেছেন একজন স্বাধীনচেতা নারী হিসেবে।
সবশেষে বাঁধন লেখেন, “এই ধরনের বিচার-বিশ্লেষণ আমাকে খুব কষ্ট দেয়—আর ঘৃণাও লাগে। কিন্তু এটাই আমাদের, নারীদের, প্রতিদিনের বাস্তবতা।”
এই মন্তব্যের মধ্য দিয়ে তিনি সমাজের গভীর এক ব্যাধিকে তুলে ধরেছেন—যেখানে নারীদের পছন্দ, পোশাক, জীবনযাপন, সবকিছুই একটি ছাঁচে ফেলার চেষ্টা করা হয়।
আজমেরী হক বাঁধনের এই স্ট্যাটাস শুধু একটি ব্যক্তিগত উপলব্ধি নয়—বরং বহু নারীর অভিজ্ঞতার প্রতিধ্বনি। তাঁর বক্তব্য আমাদের মনে করিয়ে দেয়, একজন নারীর স্বাধীনতা ঠিক কতভাবে খণ্ডিত হয় সামাজিক নিয়ম-নীতি, চর্চা ও মানসিকতায়।
বাঁধন দেখিয়ে দিয়েছেন, একজন নারী হয়তো একাধিকবার ভেঙে পড়তে পারেন, কিন্তু প্রত্যেকবারই তিনি দাঁড়াতে পারেন নিজের শক্তিতে। তার স্বাধীনচেতা মনোভাব বহু নারীর জন্য প্রেরণা হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ