
ছবি: সংগৃহীত
বর্তমান সময়টা একেবারেই সহজ যাচ্ছে না বাংলা সিনেমার পরিচিত মুখ নুসরাত ফারিয়ার জন্য। জনপ্রিয়তা, সাফল্য আর আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকলেও তার জীবনযাপন আজ ভীষণ এক বিষণ্ন বাস্তবতায় আবদ্ধ। ক্যামেরার পেছনে তার এই লড়াইয়ের এক ঝলক মিলেছে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক আবেগঘন স্ট্যাটাসে, যেখানে তিনি নিজের মানসিক অবস্থার, ডিপ্রেশন, ট্রমা ও সোশ্যাল মিডিয়ার ‘অনলাইন ট্রায়ালের’ কথা তুলে ধরেছেন—স্পষ্ট ভাষায়, কিন্তু ভীষণ মর্মস্পর্শী এক আবেদনে।
বেশ কিছুদিন আগে হঠাৎ করেই ব্যক্তিগত কিছু ঘটনার জেরে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন ফারিয়া। সেই অবস্থায় তাকে হাসপাতালে নিতে হয়, পরে চিকিৎসকের পরামর্শে তিনি বর্তমানে বিশ্রামে রয়েছেন। শারীরিক জটিলতার মধ্যে জ্বরেও আক্রান্ত হন তিনি। সব মিলিয়ে তার সময়টা কেটে যাচ্ছে এক অদৃশ্য লড়াইয়ের ভেতর দিয়ে—ডিপ্রেশন ও একাকীত্বের কঠিন ধাপে। তবে থেমে যেতে চান না। অন্ধকার সময় পেরিয়ে আবারো আলোর পথে ফিরতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন তিনি।
২৩ জুলাই (বুধবার) সন্ধ্যায় নিজের ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া একটি দীর্ঘ স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, “ডিপ্রেশন আর ট্রমা নিছক কল্পনা নয়। এটা বাস্তব। এটা নিঃশব্দ। কিন্তু ভেতর থেকে একজন মানুষকে ধ্বংস করে দেয়।”
তিনি জানান, এই মানসিক যন্ত্রণা অনেক সময় শুরু হয় শৈশব থেকেই—যেখানে কোনো একটি ঘটনা জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। আর একবার যখন কেউ সেই অবসাদের জগতে ঢুকে পড়ে, তখন তার পক্ষে স্বাভাবিক জীবনযাপন করাটা দুঃসহ হয়ে ওঠে।
তার স্ট্যাটাসের সবচেয়ে তীব্র ও ব্যথাতুর অংশ ছিল সোশ্যাল মিডিয়া ট্রায়াল নিয়ে লেখা বক্তব্য। ফারিয়া লেখেন, “আজকের দিনে একটা ভুল, একটা মুহূর্ত পুরো সমাজের সামনে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিটি মানুষ হয়ে ওঠে বিচারক। তখন একজনের পক্ষে নিজের জীবনটা আগের মতো করে বাঁচা আর সম্ভব হয় না।”
তিনি উল্লেখ করেন, “এই অনলাইন ট্রায়াল, এই নির্মমতা শুধু একজনকে নয়—তার পুরো পরিবারকেই গভীর ট্রমার মধ্যে ফেলে দেয়। ভিউয়ের পেছনে ছুটতে ছুটতে আমরা যদি একটু থামতাম, একটু ভাবতাম—তাহলে হয়তো এই অমানবিকতা একটু কম হতো।”
এই কথাগুলো যেন কেবল একজন অভিনেত্রীর ব্যক্তিগত উপলব্ধিই নয়, বরং এই সময়ের হাজারো তরুণ-তরুণীর নিঃশব্দ কান্নার প্রতিধ্বনি। কারণ সোশ্যাল মিডিয়ায় বিচারবিহীন সমালোচনা এখন যেন এক রীতিতে পরিণত হয়েছে, যার ভয়াবহ মূল্য চোকাতে হয় ব্যক্তি ও তার পরিবারকে।
বহু বছর ধরে নুসরাত ফারিয়া শুধু বাংলাদেশের বিনোদন জগতেই নয়, পশ্চিমবঙ্গের টালিউডেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন এক শক্তিশালী অভিনেত্রী হিসেবে। গ্ল্যামার, হাসিমুখ, আলো আর ক্যামেরার ঝলকে তাকে ঘিরে রাখলেও বাস্তব জীবনের ভেতরটা ছিল অনেকটাই আলাদা।
‘বস টু’, ‘ধ্যাততেরিকি’, ‘শাহেনশাহ’, ‘অপারেশন সুন্দরবন’, কিংবা সাম্প্রতিক ‘জ্বীন ৩’—এমন অনেক সিনেমার মাধ্যমে নিজেকে প্রমাণ করে এলেও, মানসিক চাপের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়েছে নীরবে। ঈদের পর আর কোনো কাজে তাকে দেখা যায়নি।
নুসরাত ফারিয়ার স্ট্যাটাসের মধ্যে একটা শক্তি আছে—একটা সাহস। তিনি থেমে থাকতে চান না। ডিপ্রেশনকে তিনি যেমন অস্বীকার করেননি, তেমনি হার মানতেও চান না। এর মধ্যেই কাজের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন তিনি। আবারো ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে চান, নিজের স্বপ্নকে ছুঁতে চান।
তার এই লড়াই শুধু একজন অভিনেত্রীর নয়—মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা তৈরির এক জরুরি বার্তা। সোশ্যাল মিডিয়ার দুনিয়ায় যেখানে সহজেই কাউকে আক্রমণ করে ফেলা যায়, সেখানে নুসরাতের মতো সাহসী কণ্ঠ আমাদের মনে করিয়ে দেয়—প্রতিটি লাইকের, প্রতিটি কমেন্টের পেছনে একজন মানুষ আছে। তার যন্ত্রণার, লড়াইয়ের গল্পও আছে।
এই স্ট্যাটাসে অনেকেই ফারিয়ার পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। ভক্ত, সহকর্মী, শুভানুধ্যায়ীরা কমেন্টে জানিয়েছেন সমর্থন ও ভালোবাসা। হয়তো এই ভালোবাসাই তাকে আবারো সামনে এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে।
নুসরাত ফারিয়া যেভাবে নিজের দুর্বলতা প্রকাশ করলেন, তা এক সাহসী পদক্ষেপ। কারণ এ সমাজে এখনো মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কথা বলাটা অনেকের কাছে ‘লজ্জার’ বিষয়। তিনি সেই দেয়ালটা ভেঙে দিয়েছেন।
সত্যিকারের সুপারস্টার শুধু ক্যামেরার সামনে থাকেন না, তারা লড়াই করেন ভেতরের অন্ধকারের সঙ্গেও—আর জিতলে শুধু নিজের জন্য নয়, সমাজেরও জন্য নতুন পথ দেখিয়ে যান। নুসরাত ফারিয়া হয়তো সেই পথেই হাঁটছেন এখন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ