
ছবি: সংগৃহীত
দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ৩০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ফিরে এসেছে, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অগ্রগতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ নানা চাপের মধ্যে এই অর্জন অর্থনীতিতে আশার আলো ছড়াচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বৃহস্পতিবার (২৫ জুলাই) পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩ হাজার ৪৫ কোটি ডলার, অর্থাৎ ৩০ দশমিক ৪৫ বিলিয়ন ডলার। এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান।
যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে, তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড ‘ব্যালেন্স অব পেমেন্ট অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টমেন্ট পজিশন ম্যানুয়াল (বিপিএম-৬)’ অনুসারে রিজার্ভের পরিমাণ একটু ভিন্ন। এই পদ্ধতিতে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়ায় ২ হাজার ৪৯৮ কোটি ৮২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, অর্থাৎ প্রায় ২৪ দশমিক ৯৮ বিলিয়ন ডলার, যা আন্তর্জাতিকভাবে গ্রহণযোগ্য ‘নেট রিজার্ভ’ হিসাবেই বিবেচিত হয়।
এখানে উল্লেখ্য, বিপিএম-৬ পদ্ধতি অনুসারে শুধুমাত্র তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবহারযোগ্য মুদ্রা ও সোনা রিজার্ভ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়, যার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থনৈতিক সক্ষমতা মূল্যায়ন করে থাকে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে প্রবাসী আয়ের প্রবাহ এবং রপ্তানি আয় কিছুটা বৃদ্ধি পাওয়ায় রিজার্ভে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে।
বিশেষ করে ঈদুল আজহার আগে ও পরে দেশে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ফলে জুলাই মাসজুড়ে বৈদেশিক মুদ্রার প্রবাহ ইতিবাচক থাকে। পাশাপাশি তৈরি পোশাক খাতসহ প্রধান রপ্তানি খাতগুলো থেকেও উল্লেখযোগ্য বৈদেশিক আয় আসায় রিজার্ভে তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পড়ে।
আরিফ হোসেন খান বলেন, “রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের ইতিবাচক ধারা বজায় থাকায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা ধরে রাখা সম্ভব হয়েছে।”
প্রসঙ্গত, চলতি বছরের ৩ জুলাই পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজস্ব হিসাব অনুযায়ী বৈদেশিক মুদ্রার মোট রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার, আর বিপিএম-৬ অনুযায়ী সেই সময় রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ২৬ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার। ওই সময় ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ ছিল প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।
তবে এরপরেই বাংলাদেশ ব্যাংক এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু) এর সদস্য দেশগুলোর কাছে প্রায় ২ দশমিক ০২ বিলিয়ন ডলার পরিশোধ করে, যার প্রভাবে জুলাইয়ের মাঝামাঝিতে রিজার্ভে সাময়িক ধস নামে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, আকু পরিশোধের ধাক্কা সামলে রিজার্ভ ফের ঘুরে দাঁড়ানো প্রমাণ করে যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন আরও গতিশীল ও দক্ষ হচ্ছে। বিশেষ করে আমদানি নিয়ন্ত্রণ ও অবৈধ হুন্ডি বন্ধে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নেওয়া উদ্যোগগুলো কার্যকর হচ্ছে বলেই রিজার্ভ পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক ফল মিলেছে।
বিশ্লেষকরা বলছেন, যদিও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (IMF) এর নির্ধারিত ন্যূনতম রিজার্ভের শর্ত পূরণে আরও কিছুটা পথ বাকি, তবে সামগ্রিক চিত্র আগের তুলনায় অনেকটাই স্থিতিশীল।
একজন ব্যাংকিং বিশ্লেষক বলেন, “সঠিক ব্যবস্থাপনা অব্যাহত থাকলে বছরের শেষ নাগাদ বিপিএম-৬ অনুযায়ী রিজার্ভ ২৭ বিলিয়নের কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটি নিরাপদ সীমা।”
বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। এটি শুধু আমদানি সক্ষমতা বা ঋণ পরিশোধেই নয়, বরং বৈদেশিক ঋণপ্রাপ্তি, বিনিয়োগের আস্থা এবং মুদ্রানীতি নির্ধারণেও বড় ভূমিকা রাখে।
তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এই রিজার্ভ পুনরুদ্ধার শুধু সংখ্যাগত নয়, বরং অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার দক্ষতা এবং ভবিষ্যৎ আর্থিক পরিকল্পনার ওপর আস্থা সৃষ্টির একটি শক্তিশালী বার্তা। তবে এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স উভয় ক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রবণতা বজায় রাখা এবং বৈদেশিক লেনদেন ব্যবস্থাপনায় আরও স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা আনা জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ