
ছবি: সংগৃহীত
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইলি বাহিনীর লাগাতার বিমান হামলা, গোলাবর্ষণ এবং স্থল অভিযান ক্রমেই ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) দিনভর চালানো নতুন দফার সহিংস অভিযানে ইসরাইলি বাহিনী একদিনেই হত্যা করেছে আরও ৮৯ জন ফিলিস্তিনিকে। একই সঙ্গে আহত হয়েছে কমপক্ষে ৪৫৩ জন মানুষ। চলমান এই সহিংসতার ফলে গাজায় মোট মৃত্যুর সংখ্যা ভয়ংকর এক মাইলফলকে পৌঁছে গেছে—৫৯ হাজার ৫৮৬ জন।
এই তথ্য নিশ্চিত করেছে বার্তাসংস্থা আনাদোলু, যা ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানায়। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ৮৯টি মরদেহ নিয়ে আসা হয়েছে। আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আরও বহু মানুষ এখনও ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন বা খোলা রাস্তায় পড়ে আছেন যাদের কাছে পৌঁছাতেই পারছে না উদ্ধারকারীরা, যেহেতু ইসরাইলি গোলাবর্ষণ ও হামলা এখনও থামেনি।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ইসরাইলি সেনাবাহিনীর বেপরোয়া আক্রমণে হাসপাতাল ও অ্যাম্বুলেন্স ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। পিছু হঠার কোনো সুযোগ ছাড়াই ইসরাইলি ড্রোন, যুদ্ধবিমান এবং স্থলসেনারা যত্রতত্র বোমা ফেলছে, বিশেষ করে ত্রাণ সংগ্রহের লাইনে থাকা সাধারণ মানুষের ওপর।
বর্তমানে গাজায় মানবিক পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ যে, মানুষ এখন শুধুমাত্র একমুঠো খাবার বা এক বোতল পানির জন্য জীবন দিয়ে দিচ্ছে। বৃহস্পতিবারও এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে—ত্রাণ সংগ্রহের চেষ্টাকালে ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় আরও ২৩ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও ৬৮ জনের বেশি।
এই ধরনের সহিংসতা আগেও ঘটেছে। গত ২৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত শুধুমাত্র ত্রাণ সংগ্রহের সময় ইসরাইলি বাহিনীর হামলায় নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৮৩ জন ফিলিস্তিনি এবং আহত হয়েছেন ৭ হাজার ২৭৫ জন। এই পরিসংখ্যান আরও ভয়াবহ হয়ে উঠছে কারণ অনেক আহত ব্যক্তি চিকিৎসার সুযোগ না পেয়ে মারা যাচ্ছেন, অথবা প্রয়োজনীয় ওষুধ ও খাবারের অভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছেন।
ফিলিস্তিনের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ২৭৯ জন নিহত ব্যক্তির পরিচয় শনাক্ত করে সরকারিভাবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। এতে করে মোট নিহতের সংখ্যা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। এসব মানুষ আগে আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন কিংবা উদ্ধারকারী দল তাদের মরদেহ অনেক দিন পর খুঁজে পায়।
চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারিতে যে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তি কার্যকর হয়েছিল, সেটি মাত্র দুই মাসের মাথায় ১৮ মার্চ ভেঙে ফেলে ইসরাইল। এরপর থেকে দেশটি আবারও পূর্ণমাত্রায় হামলা শুরু করে গাজা ভূখণ্ডজুড়ে।
চুক্তি ভেঙে হামলা শুরুর পরবর্তী সময়েই সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে। মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ১৮ মার্চ থেকে এখন পর্যন্ত ৮ হাজার ৪৪৭ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং ৩১ হাজার ৪৫৭ জন আহত হয়েছেন।
গাজা শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়ে আছেন শত শত মানুষ, যাদের জীবিত কিংবা মৃত অবস্থায় বের করে আনার কোনো উপায় নেই। উদ্ধারকারী দলগুলো ইসরাইলি সেনাদের ক্রমাগত হামলার কারণে নিরাপদভাবে ঘটনাস্থলে পৌঁছাতে পারছে না। ফলে অনেক মরদেহ রাস্তায় পচে যাচ্ছে কিংবা আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নেওয়া মানুষের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ছে।
এই ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যেও আন্তর্জাতিক মহলের নীরবতা প্রশ্নবিদ্ধ। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিংবা যুক্তরাষ্ট্র এখনও পর্যন্ত ইসরাইলকে কার্যকরভাবে থামাতে কোনও বাধ্যতামূলক পদক্ষেপ নেয়নি। অথচ গত কয়েক মাসেই শিশু, নারী ও বৃদ্ধসহ হাজার হাজার নিরপরাধ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসন যেন থামছেই না। দিনে দিনে প্রাণহানি এবং মানবিক বিপর্যয়ের মাত্রা অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কার্যকর হস্তক্ষেপ ছাড়া এই ভয়াবহ গণহত্যা থামবে না বলেই আশঙ্কা করছেন মানবাধিকারকর্মীরা। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এই অবস্থা একটি সুস্পষ্ট মানবতাবিরোধী অপরাধের নামান্তর—যা মানব সভ্যতার চরম লজ্জা হয়ে ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ