
ছবি: সংগৃহীত
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক বিশাল পদযাত্রা ও সমাবেশে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম ঘোষণা দিয়েছেন, আগামী ৫ আগস্টের মধ্যেই ‘জুলাই সনদ’ ও ঘোষণাপত্র আদায় করা হবে। দেশের রাজনৈতিক সংস্কার, বিচার ও একটি নতুন সংবিধানের দাবিতে এনসিপি যেভাবে মাঠে সক্রিয় হয়েছে, তা এখন দেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক শক্তিকেও প্রভাবিত করছে বলে দাবি করেছেন তিনি।
বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) সকাল থেকে শুরু হওয়া এনসিপির ২৪তম দিনের ‘জুলাই পদযাত্রা’ কর্মসূচি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। এ দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের জেলা পরিষদ সড়ক এলাকায় হাজারো মানুষের অংশগ্রহণে এক বর্ণাঢ্য পদযাত্রার আয়োজন করা হয়। এর মধ্য দিয়ে এনসিপি শুধু রাজনৈতিক দাবি নয়, বরং গণআন্দোলনের শক্তি ও সচেতনতার বার্তা পৌঁছে দেয় জনগণের কাছে।
দিনের শুরুতেই এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ জুলাই মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ঘটে যাওয়া গণঅভ্যুত্থানে শহিদ ও আহতদের পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। পরে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নের দাবিতে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে পদযাত্রা শুরু হয়।
পদযাত্রাটি জেলা পরিষদ সড়ক থেকে শুরু হয়ে শহরের টিএ রোড, মসজিদ রোড, কুমারশীল মোড়সহ গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলো প্রদক্ষিণ করে। রাস্তায় সাধারণ মানুষ, ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীরাও এই মিছিলে স্বতঃস্ফূর্তভাবে হাত মেলান। মিছিল শেষে শহরের কেন্দ্রীয় পৌর মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় সমাবেশ, যেখানে দেশব্যাপী সাংগঠনিক আন্দোলনের পরবর্তী ধাপ সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়।
সমাবেশে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম। তিনি বলেন, “এনসিপি নতুন সংবিধান, বিচার ও গণতান্ত্রিক সংস্কারের দাবিতে আপসহীন। আমরা ফ্যাসিবাদ ও একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে যে লড়াই শুরু করেছি, তাতে এখন অনেক রাজনৈতিক দলই নিজেদের অবস্থান পুনর্বিবেচনা করছে।”
তিনি আরও বলেন, “আগামী ৫ আগস্টের মধ্যে আমাদের দাবি আদায় করতে হবে। এটি কেবল এনসিপির দাবি নয়, এটি দেশের মানুষের, গণতন্ত্রপ্রিয় জনগণের দাবি। যে ‘জুলাই সনদ’ আমরা ঘোষণা করেছি, তা বাস্তবায়ন ছাড়া সামনে এগিয়ে যাওয়ার কোনো পথ নেই।”
নাহিদ বলেন, “ব্রাহ্মণবাড়িয়া সবসময়ই ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে। এই মাটিতে একাধিকবার জীবন দিয়ে প্রমাণ হয়েছে, এ জনপদ কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত করে না।”
দক্ষিণাঞ্চলীয় মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, “অনেকে ভেবেছিল ফ্যাসিবাদের পতন ঘটেছে। কিন্তু আমরা দেখছি মাইলস্টোন ট্র্যাজেডির মতো মর্মান্তিক ঘটনার আবেগকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগ আবার পুনর্গঠিত হওয়ার অপচেষ্টা করছে।”
তিনি বলেন, “ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিটি দলকে এখন একজোট হতে হবে। বিভক্ত থেকে রাজনীতি করলে গণতন্ত্র ফিরবে না, বরং শোষণ ও নিপীড়নের চক্র অব্যাহত থাকবে। এখন সময় এসেছে, রাজনীতির ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে প্রতিটি পক্ষকে একত্রিত হওয়ার।”
সমাবেশে বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে কোনো সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে তা আবারও একদলীয় কর্তৃত্ববাদে পরিণত হবে। তাই ‘জুলাই সনদে’ যেসব সংস্কার প্রস্তাব রাখা হয়েছে—নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা, বিচার বিভাগের পুনর্গঠন, দলীয় প্রতীকবিহীন স্থানীয় নির্বাচন, স্বতন্ত্র সংসদীয় মনোনয়নসহ—এসব বাস্তবায়নের মাধ্যমেই একটি অন্তর্বর্তীকালীন গ্রহণযোগ্য সরকার গঠন করতে হবে।
আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেন, “আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পালাবদলের খেলা জনগণ আর দেখতে চায় না। আমরা চাই সুশাসন, আইনের শাসন এবং একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র কাঠামো। তাই সংস্কার আন্দোলন হচ্ছে সময়ের দাবি, এটাই আমাদের রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।”
এই কর্মসূচিতে এনসিপির কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা-কর্মীরা অংশ নেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটোয়ারী, সিনিয়র যুগ্ম সদস্য সচিব ডা. তাসনিম জারা, সংগঠক সামান্তা শারমিন, কেন্দ্রীয় সংগঠক আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ জিহান, দক্ষিণাঞ্চলীয় যুগ্ম মুখ্য সংগঠক মো. আতাউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শাখার প্রধান সমন্বয়কারী আজিজুর রহমান লিটন, সিনিয়র যুগ্ম সমন্বয়কারী এসএম মহিউদ্দিন খানসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার নেতারা।
এই পদযাত্রায় রাজনীতির বাইরেও নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ অংশ নেন। বিশেষ করে তরুণদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। কেউ স্লোগান লিখেছেন পোস্টারে, কেউ গান গেয়ে জানান দিয়েছেন তাদের সমর্থনের কথা।
সমাবেশ শেষে এনসিপির পদযাত্রার গাড়িবহর পার্শ্ববর্তী জেলা হবিগঞ্জের উদ্দেশে রওনা হয়। এনসিপির নেতারা জানিয়েছেন, আগামী কয়েকদিন হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, সিলেটসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলায় পদযাত্রা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া হবে। ৫ আগস্টে ঢাকায় জাতীয় সমাবেশের মাধ্যমে এই আন্দোলনের প্রথম ধাপের সমাপ্তি টানা হবে।
এই পদযাত্রা এবং ঘোষণা শুধুমাত্র রাজনৈতিক কর্মসূচির অংশ নয়—এটি হয়ে উঠছে একটি আন্দোলনের রূপান্তর। ৫ আগস্টের মধ্যে ‘জুলাই সনদ’ আদায়ের ডাক ও ফ্যাসিবাদবিরোধী ঐক্যের আহ্বান বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন এক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এখন দেখার বিষয়, অন্যান্য রাজনৈতিক শক্তিগুলো এই আহ্বানে কীভাবে সাড়া দেয় এবং শাসনব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত সংস্কারের পথে কতদূর অগ্রসর হয়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ