
ছবি: সংগৃহীত
রাজধানীর উত্তরা দিয়াবাড়িতে অবস্থিত মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান বিধ্বস্ত হয়ে ঘটে যাওয়া ভয়াবহ দুর্ঘটনার পর ক্রমেই খুলছে হৃদয়বিদারক সব চিত্রের পর্দা। আগুনে পুড়ে বিকৃত হয়ে যাওয়া দেহাবশেষ থেকে পাঁচজন নিহতের পরিচয় শনাক্ত করা হয়েছে ফরেনসিক পরীক্ষার মাধ্যমে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) বিকেলে ডিএনএ পরীক্ষার এই তথ্য নিশ্চিত করে।
সিআইডির ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, বিধ্বস্ত ও পুড়ে যাওয়া পাঁচটি মরদেহের অবশিষ্টাংশ থেকে ১১টি নমুনা সংগ্রহ করে ডিএনএ বিশ্লেষণ করা হয়। বিকেলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার জসিম উদ্দীন খান সংবাদমাধ্যমকে জানান, সেসব নমুনার ভিত্তিতে পাঁচজনের পরিচয় শনাক্ত করা গেছে। তবে কারো পরিচয় কীভাবে নিশ্চিত হয়েছে, তা বিস্তারিত জানাতে কিছুটা সময় লাগবে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
দুর্ঘটনায় নিখোঁজদের পরিবারগুলোর সদস্যদের ডিএনএ নমুনা দিয়ে শনাক্তের প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে আগেই অনুরোধ জানিয়েছিল সরকার। গত বুধবার (২৩ জুলাই) সরকারি তথ্য বিবরণীতে এক ঘোষণার মাধ্যমে নিখোঁজদের পরিবারের সদস্যদের সিআইডির মালিবাগ প্রধান কার্যালয়ে গিয়ে ডিএনএ নমুনা দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়। সেই অনুযায়ী অনেকে ইতোমধ্যেই নমুনা দিয়েছেন।
ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফল আসার সঙ্গে সঙ্গে স্বজন হারানোর নিশ্চিত বার্তা পেয়েছেন অনেকে। এতে ভারী হয়ে উঠেছে পুরো এলাকায় শোকের ছায়া।
এখনো অনেকে নিশ্চিতভাবে জানেন না তাঁদের প্রিয় সন্তান বেঁচে আছে কিনা। যারা জানেন না, তাঁদের কাছে অপেক্ষার প্রতিটি মুহূর্ত যেন মৃত্যু যন্ত্রণার চেয়েও ভয়াবহ। মাইলস্টোন স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী রাইসা মনির বাবা সাহাবুল ইসলাম বারবার ছুটে গেছেন মরদেহ শনাক্তে, কখনো হাসপাতালে, কখনো আবার সিআইডি কার্যালয়ে। তাঁর দাবি, ঘটনাস্থলে দগ্ধ হয়ে প্রাণ গেছে তাঁর আদরের মেয়েটির। তবে এখনো রাইসার মরদেহ আনুষ্ঠানিকভাবে হাতে পাননি তিনি।
আরেক অভিভাবক রাইসার মরদেহ নিজের সন্তানের বলে দাবি করছেন। শিশুর শারীরিক গঠন ও পোশাক দেখে তিনি নিশ্চিত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এই অবস্থায় দুজনের মধ্যেই রয়েছে চরম উদ্বেগ, ব্যথা ও মানসিক অস্থিরতা। ডিএনএ পরীক্ষার ফলাফলে সেই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আরেক নিখোঁজ শিক্ষার্থী আফিয়ার মাও জানেন না তাঁর সন্তান বেঁচে আছে নাকি দগ্ধ হয়ে চেনা-অচেনার সীমা পেরিয়ে গেছেন। কাঁদতে কাঁদতে স্কুলের প্রধান ফটকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন তিনি। তাঁর আকুতি—একবার যদি মেয়েকে দেখতে পেতেন!
ভোর থেকেই স্কুলের সামনে ভিড় করছেন শোকাহত অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা। তাদের চোখে-মুখে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা আর অতল বিষণ্ণতা। বেঁচে ফেরা শিক্ষার্থীরা আজো মানসিকভাবে স্থির হতে পারেনি। তারা জানে না, ক্লাসে ঢুকলে প্রিয় বন্ধুদের আর দেখবে কিনা। খেলার সাথী, টিফিন ভাগ করা বন্ধু, কিংবা গানের প্রতিযোগিতায় একসঙ্গে গাওয়া কণ্ঠসাথী অনেকেই আর নেই। এই শূন্যতা কোনো দিন পূরণ হবে না।
স্কুলটির শিক্ষক-শিক্ষিকারাও এখনো শোকস্তব্ধ। ক্লাস বন্ধ রয়েছে। স্কুলে যারা এসেছেন, তারা শোক জানাতে কিংবা সহপাঠীদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। শ্রদ্ধা জানানো হয়েছে সেসব শিক্ষিকা ও শিক্ষার্থীদের, যারা এ দুর্ঘটনায় জীবন উৎসর্গ করেছেন।
এদিকে দুর্ঘটনায় নিহত দুই শিক্ষিকাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সম্মাননা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। তাঁদের আত্মত্যাগকে স্মরণীয় করে রাখতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সরকার বলেছে, এই মর্মান্তিক ঘটনার তদন্ত ও দায়ীদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে বিমান বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সংস্থা।
স্কুল কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে হতাহতদের সুনির্দিষ্ট তালিকা প্রণয়নের জন্য একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। কমিটির সদস্যরা কাজ শুরু করলেও এখনো গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেননি। স্কুলের তরফ থেকেও আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
সরকারি সূত্র মতে, এই পর্যন্ত ৩৩ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে। তবে আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই সংখ্যা আরও বাড়তে পারে, কারণ এখনো কয়েকজন নিখোঁজ রয়েছেন এবং হাসপাতালে চিকিৎসাধীন কয়েকজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এই দুর্ঘটনা কেবলমাত্র একটি স্কুল বা একটি এলাকার ক্ষতি নয়—এটি পুরো জাতির জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। শিশুদের মৃত্যু, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হারানো এবং পরিবারগুলোর চিরন্তন বিষাদ আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সুরক্ষা নিশ্চিত না করে উন্নয়নের কথাবার্তা যেন শুধু মুখের বুলি হয় না। এই ঘটনায় যেসব প্রাণ ঝরে গেল, তারা যেন আমাদের ঘুম না হারায়—এই হোক জাতির শপথ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ