
ছবি: সংগৃহীত
অবশেষে শুরু হতে যাচ্ছে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে সংঘটিত ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ গণ-অভ্যুত্থান ও সেই প্রেক্ষাপটে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারিক প্রক্রিয়া। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে চারটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার ফরমাল চার্জ (আনুষ্ঠানিক অভিযোগ) আমলে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে অন্যতম একটি মামলায় প্রধান আসামি হিসেবে নাম রয়েছে পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। চলতি বছরের আগস্ট মাসেই এসব মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
এই চারটি মামলার মধ্যে রয়েছে—
শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ,
রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় ৬ শিক্ষার্থীকে গুলি করে হত্যার মামলা,
আশুলিয়ায় ৬ আন্দোলনকারীকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যার মামলা এবং
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ হত্যাকাণ্ড।
২০২৫ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের নির্দেশদাতা, পরিকল্পনাকারী ও দায়িত্বশীল ‘সুপিরিয়র কমান্ডার’ হিসেবে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা ১২ মে প্রতিবেদন জমা দেয়। এরপর ১০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ আনুষ্ঠানিকভাবে শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে বিচার শুরুর আদেশ দেন।
অন্য দুই আসামি হলেন সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। এদের মধ্যে একমাত্র কারাগারে আটক আবদুল্লাহ আল মামুন আদালতের কাছে দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হওয়ার আবেদন জানালে তা মঞ্জুর করেন ট্রাইব্যুনাল।
আদালতের আদেশ অনুযায়ী, এই মামলায় প্রসিকিউশনের ওপেনিং স্টেটমেন্ট (প্রারম্ভিক বক্তব্য) ৩ আগস্ট এবং সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হবে ৪ আগস্ট। বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যবিশিষ্ট ট্রাইব্যুনাল-১। অপর দুই সদস্য হলেন বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী।
২০২৫ সালের ৫ আগস্ট, শেখ হাসিনার সরকারের পতনের দিনে রাজধানীর চানখাঁরপুল এলাকায় শিক্ষার্থী শহীদ আনাসসহ ছয়জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানসহ আটজনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এই মামলায় ১৪ জুলাই অভিযোগ গঠন করে আসামিদের অব্যাহতির আবেদন খারিজ করে দেয়। আদালত ১০ আগস্ট মামলার ওপেনিং স্টেটমেন্ট এবং ১১ আগস্ট সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ নির্ধারণ করেছেন।
মানবতাবিরোধী এই ঘটনায়ও ভয়াবহতা কম নয়। আশুলিয়ায় ৬ আন্দোলনকারীকে জীবন্ত পুড়িয়ে হত্যার দায়ে দায়ের করা মামলায় সাবেক এমপি মুহাম্মদ সাইফুল ইসলামসহ মোট ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৮ জন পলাতক। বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন ট্রাইব্যুনাল-২ ১৬ জুলাই আটজন পলাতক আসামির বিরুদ্ধে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের নির্দেশ দেন এবং ২৮ জুলাই মামলার পরবর্তী শুনানির তারিখ নির্ধারণ করেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, ২৪ জুন ওই ছয় আন্দোলনকারীকে পরিকল্পিতভাবে গণগ্রেফতারের পর নির্জন স্থানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং সেখানে তাঁদের আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তদন্ত সংস্থা ২ জুলাই এ মামলার ফরমাল চার্জ আমলে নেওয়ার আবেদন জানালে তা গ্রহণ করেন আদালত।
রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আবু সাঈদ ছিলেন জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের প্রথম শহীদদের একজন। তাঁকে হত্যার ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ৩০ জনকে আসামি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে ২৪ জনই এখনও পলাতক।
এই মামলার অভিযোগ গঠনের শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে ২৮ জুলাই। মামলাটি পরিচালনা করছেন বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২। বাকি দুই বিচারক হলেন মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
জুলাই গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকে এ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মোট ২৭টি মামলা হয়েছে, যার মধ্যে ২৩টি বিবিধ মামলা বা মিস কেস। মাত্র চারটি মিস কেস নিয়মিত মামলায় রূপ নিয়েছে এবং তারই বিচার শুরু হতে যাচ্ছে।
এই চারটি মামলায় আসামির সংখ্যা ৫৭। প্রসিকিউশন সূত্র বলছে, মোট ২০৬ জনের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ উঠেছে, যাদের মধ্যে এখন পর্যন্ত ৭৩ জনকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি ১৩২ জন এখনও পলাতক।
প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ বলেন, “সবকিছু আদালতের এখতিয়ার। তবে আমাদের আশা, আগস্ট থেকেই এই চারটি মামলার বিচারিক কার্যক্রম পুরো মাত্রায় শুরু হবে। আমরা প্রস্তুত।”
শেখ হাসিনা ও তাঁর সরকারের শাসনামলের নানা পর্যায়ে সংঘটিত গুম, খুন ও দমন-পীড়নের অভিযোগ বহুদিন ধরেই মানুষের মুখে মুখে। ২০২৫ সালের জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের ভয়াবহতা, তাতে সরকারি বাহিনী ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকা, এবং নির্যাতিত জনগণের ওপর চালানো দমনমূলক অভিযান যে ইতিহাসের অন্যতম নিষ্ঠুর অধ্যায়—তা এখন আন্তর্জাতিক আইনি প্রক্রিয়ার মুখোমুখি।
আগস্ট মাস থেকে শুরু হতে যাওয়া এই বিচার শুধু কিছু নির্দিষ্ট অপরাধের নয়; এটি পুরো একটি দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের প্রত্যাশিত ন্যায়বিচারের যাত্রা। এই যাত্রার সফলতা নির্ভর করবে আদালতের স্বাধীনতা, সাক্ষ্যপ্রমাণের নির্ভুল উপস্থাপন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পর্যবেক্ষণ ও সমর্থনের ওপর।
বাংলাবার্তা/এমএইচ