
ছবি: সংগৃহীত
দেশের ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায় এক ঐতিহাসিক পরিবর্তনের পথ প্রশস্ত করলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এখন থেকে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর সর্বোচ্চ ১২ ঘণ্টার মধ্যে তার পরিবার, নিকট আত্মীয়, বন্ধু অথবা আইনজীবীর সঙ্গে যোগাযোগ করে গ্রেফতারের বিষয়টি অবহিত করতে হবে। ফৌজদারি কার্যবিধির এমনই একটি গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী প্রস্তাব বৃহস্পতিবার (২৪ জুলাই) অনুমোদন দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ।
প্রধান উপদেষ্টার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে সংশোধনী প্রস্তাব অনুমোদিত হয়। সংশোধনীটি আইনে রূপ নিলে পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কোনো ব্যক্তিকে থানায় নিয়ে গেলে আর গোপন রাখার সুযোগ থাকবে না। ১২ ঘণ্টার মধ্যে ওই ব্যক্তির পরিবার বা প্রতিনিধিকে জানানো বাধ্যতামূলক হবে।
বৈঠক শেষে রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক সংবাদ সম্মেলনে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল এ তথ্য জানান। তিনি বলেন, “এই সংশোধনী শুধুই একটি প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত নয়, এটি একটি মৌলিক মানবাধিকার সংরক্ষণের পদক্ষেপ। দীর্ঘদিন ধরে নানা মহল থেকে অভিযোগ উঠেছে, কাউকে গ্রেফতারের পর অনেক সময় পরিবার জানতেই পারে না, কোথায় রাখা হয়েছে, কী অবস্থা তার। এতে করে ব্যক্তি ও তার পরিবার উভয়েই মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হন।”
ড. নজরুল আরও বলেন, “আমরা সংবিধান ও উচ্চ আদালতের নির্দেশনার আলোকে একটি সময়সীমা নির্ধারণ করেছি। এটি বাস্তবায়ন হলে পুলিশের কাজেও স্বচ্ছতা আসবে এবং নাগরিকদের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ কিছুটা হলেও কমবে।”
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ সংবিধান এবং বিদ্যমান ফৌজদারি কার্যবিধি অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতারের পর ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তাকে ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে হাজির করা বাধ্যতামূলক। পাশাপাশি হাইকোর্টের পূর্ববর্তী একাধিক নির্দেশনায় বলা হয়েছে, কাউকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে তার স্বজনদের জানাতে হবে। তবে বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রেই এই নির্দেশনা মানা হয় না। ফলে পরিবার-পরিজনরা দুশ্চিন্তায় পড়েন এবং সন্দেহজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়।
সংশোধনীর মাধ্যমে এবার তা আইনের কাঠামোয় সুনির্দিষ্ট সময়সীমায় অন্তর্ভুক্ত হলো। ফলে এখন থেকে কেউ এই বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করলে তার বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বহুদিন ধরেই দাবি করে আসছিল যে, গ্রেফতারের পর ব্যক্তিকে ‘নিখোঁজ’ বানিয়ে রাখার প্রবণতা বন্ধ করতে হলে পরিবারকে দ্রুত জানানো বাধ্যতামূলক করতে হবে। অনেক সময় দেখা গেছে, কেউ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হয়েছেন, অথচ পরিবার জানে না তিনি কোথায়। কয়েকদিন পর কোথাও মৃতদেহ পাওয়া গেছে কিংবা আদালতে হাজির করায় বিষয়টি জানাজানি হয়েছে।
এ ধরনের ঘটনা রোধে ‘গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে’ অথবা একটি নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যে পরিবারের সদস্যদের জানানো জরুরি বলে অভিমত জানিয়ে আসছিলেন অধিকারকর্মীরা। এবার ১২ ঘণ্টার সময়সীমা নির্ধারণ হওয়ায় সেটি অনেকটাই পূরণ হলো।
আইন উপদেষ্টা জানান, সংশোধনী প্রস্তাব আইনে রূপ নিতে এখন প্রজ্ঞাপন আকারে জারি করা হবে এবং পরবর্তীতে সেটি গেজেট আকারে প্রকাশ করা হবে। এরপর সংশ্লিষ্ট থানাগুলোতে এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মধ্যে এই বিধান কার্যকর করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা পৌঁছে দেওয়া হবে।
এছাড়া এই আইনি বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা হলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয়েও নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
ঘোষণার পর পুলিশের একটি সূত্র জানায়, তারা এই সিদ্ধান্তকে ইতিবাচকভাবে নিয়েছে। পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, “আমাদের কাজের স্বচ্ছতা বাড়াতে এই নির্দেশনা সহায়ক হবে। এতে নির্দোষ কেউ হয়রানির শিকার হলে পরিবারের সহায়তা দ্রুত পাওয়া যাবে, একইসঙ্গে আমাদের কার্যক্রম নিয়েও ভুল ধারণা তৈরি হবে না।”
সংশোধনীটি নিয়ে ইতিমধ্যে আইনজীবী মহল, মানবাধিকার সংস্থা এবং নাগরিক সমাজ থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যাচ্ছে। সিনিয়র আইনজীবী ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, “এটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটি পদক্ষেপ। বহু বছর ধরে আমরা এমন একটি বাধ্যতামূলক সময়সীমা চাইছিলাম। কারণ এটি না থাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ইচ্ছেমতো কাউকে গুম বা নিখোঁজ রাখার সুযোগ পেয়ে যেত।”
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্লাস্ট)-এর নির্বাহী পরিচালক শামীমা ইয়াসমিন বলেন, “এই সংশোধনী বাস্তবায়নের মাধ্যমে শুধু মানবাধিকার সংরক্ষিত হবে না, বরং আইনের প্রতি জনগণের আস্থাও বাড়বে।”
বাংলাবার্তা/এমএইচ