
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় সংসদ নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসছে, দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন ততটাই সরগরম হয়ে উঠছে। প্রতিটি বড় দল এখন ভোটব্যাংক বাড়ানোর জন্য নতুন কৌশল, নতুন জোট এবং নতুন সমঝোতার পথে হাঁটছে। বিশেষ করে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী এবং জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ঘিরে জনমনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে—তারা কাদের সঙ্গে জোট করবে, আবার কারা বাইরে থাকবে? রাজনৈতিক মহল বলছে, ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনের তিন প্রধান স্টেকহোল্ডার ইতোমধ্যেই সমঝোতার পথে এগোচ্ছে, যদিও প্রকাশ্যে এখনও তারা একে অপরের সমালোচনা করছেন।
গণঅভ্যুত্থানের পর জুলাই সনদ এখন বিরোধী রাজনীতির কেন্দ্রীয় নথি। তবে এ সনদ ঘিরেই বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি চায় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন করে সনদের বাস্তবায়ন ধাপে ধাপে করা হোক। অন্যদিকে জামায়াতের অবস্থান হলো—জুলাই সনদকে নির্বাচন পূর্বশর্ত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই মতপার্থক্য সমাধানে পশ্চিমা কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা নিচ্ছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডার কিছু কূটনীতিক সম্প্রতি বিএনপি ও জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করেছেন। তাদের উদ্দেশ্য—ফেব্রুয়ারির নির্বাচনকে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলা।
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সফরসঙ্গী হিসেবে বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপির কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা বর্তমানে নিউইয়র্কে রয়েছেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সফর শুধু প্রটোকল নয়, বরং আস্থার সংকট নিরসনেরও প্রচেষ্টা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক ড. মিজানুর রহমান বলেন, “এই সফরে নেতাদের পাশাপাশি নেওয়া হয়েছে মূলত পারস্পরিক সন্দেহ দূর করার জন্য। নির্বাচনের আগে আস্থার সংকট যদি কাটানো না যায়, তবে কোনো জোটই দীর্ঘস্থায়ী হবে না।”
বিএনপি ইতোমধ্যে তাদের পুরোনো সঙ্গীদের ধরে রাখার পাশাপাশি নতুন দলকেও কাছে টানছে। দলের স্থায়ী কমিটির সর্বশেষ বৈঠকে মিত্রদের জন্য আসন ছাড় দেওয়ার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সূত্র জানায়, অক্টোবরের মধ্যেই কতগুলো আসন ছাড় দেওয়া হবে তা চূড়ান্ত করবে বিএনপি।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, “আমরা এখনো কারও সঙ্গে আনুষ্ঠানিক সমঝোতায় যাইনি। তবে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকরা আমাদের সঙ্গে আছে। ইসলামি দলগুলোর সঙ্গেও সমঝোতা হতে পারে। সময় এলে সব পরিষ্কার হবে।”
জামায়াতে ইসলামী এখন দ্বিমুখী কৌশলে চলছে। একদিকে বিএনপির সঙ্গে দূরত্ব কমানোর চেষ্টা করছে, অন্যদিকে ইসলামি দলগুলোকে এক মঞ্চে আনার উদ্যোগ নিয়েছে। অন্তত সাতটি ইসলামি দল অভিন্ন কর্মসূচি পালন করছে। যদিও এর মধ্যে কয়েকটি দল হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ, যারা সরাসরি জামায়াতের সঙ্গে সমঝোতায় যেতে অনীহা প্রকাশ করছে।
জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, “বিভিন্ন দলের মধ্যে ঐক্যের আগ্রহ আছে। সময় হলে সব আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে। আপাতত সবাই মিলে এক বাক্সে ভোট দেওয়ার চেষ্টা চলছে।”
হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জমিয়াতুল মোদার্রেছীন ও ছারছীনা দরবারের মতো সংগঠনগুলোর ভোটব্যাংককে গুরুত্ব দিয়ে বিএনপি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছে। গুলশান অফিস থেকে শুরু করে বাবুনগর মাদরাসা পর্যন্ত বিএনপির শীর্ষ নেতাদের যাতায়াত হচ্ছে।
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা গাজী আতাউর রহমান বলেন, “এক বাক্সে ইসলামী দলগুলোর ভোট হলে নির্বাচনে বড় প্রভাব পড়বে। এ বিষয়ে সমঝোতার পথেই এগোচ্ছি।”
জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) ও গণঅধিকার পরিষদের মধ্যে একীভূত হওয়ার আলোচনা শুরু হয়েছে। দলের নাম ও পদবণ্টন নিয়ে এখনও সমঝোতা হয়নি, তবে তরুণ নেতাদের মধ্যে ঐক্যের ইতিবাচক সাড়া দেখা যাচ্ছে। গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেন, “তরুণরা ঐক্যবদ্ধ হলে রাজনীতিতে নতুন ধারা তৈরি হবে। আমরা এ পথে ইতিবাচকভাবে অগ্রসর হচ্ছি।”
বাংলাদেশের বামপন্থি দলগুলোও পিছিয়ে নেই। সিপিবির নেতৃত্বে বাম গণতান্ত্রিক জোট নতুন করে সক্রিয় হয়েছে। তাদের লক্ষ্য—সব বামপন্থি দল, আদিবাসী সংগঠন ও নাগরিক সংগঠনকে নিয়ে একটি বৃহৎ জোট গড়া। তবে এই জোট জামায়াতের সঙ্গে বসতে একেবারেই রাজি নয়। ফলে নির্বাচনে অন্তত একটি স্বাধীন বাম জোট থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতি মোটা দাগে তিনটি প্রধান জোটের দিকে যাচ্ছে—বিএনপি ও উদার গণতান্ত্রিক দলগুলো, জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো, এবং বাম ধারার দলগুলো। তবে এর বাইরে আরও ছোট ছোট জোট দেখা যেতে পারে।”
তার মতে, জুলাই সনদ ও নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সমঝোতা অবশ্যই হতে হবে। “জনগণ এখন আর অস্থিতিশীলতা চায় না। আলোচনার মাধ্যমেই রাজনৈতিক সংকটের সমাধান করতে হবে।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের আরেক শিক্ষক ড. শারমিন হক বলেন, “বিএনপি-জামায়াত সম্পর্কের টানাপোড়েন দীর্ঘদিনের। তবে নির্বাচনের আগে প্রয়োজন হলে তারা সমঝোতায় যাবে। মূলত ক্ষমতার সমীকরণই তাদের একত্রিত করে।”
সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হলো—কোন দল কাদের সঙ্গে যাবে এবং কতগুলো আসন ছাড়বে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অক্টোবরের পর থেকে জোট গঠন ও আসন ভাগাভাগির বিষয়গুলো স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এর মধ্যে পশ্চিমা কূটনীতিকদের সক্রিয় ভূমিকা আরও বাড়বে।
সবশেষে বলা যায়, ভোটের রাজনীতিতে এখন জটিল এক সমীকরণ তৈরি হয়েছে। বিএনপি, জামায়াত ও এনসিপি একসঙ্গে বা আলাদা জোট করুক, ইসলামি ভোট এক বাক্সে আসুক বা ছড়িয়ে যাক—সবই নির্ভর করবে আগামী কয়েক মাসের রাজনৈতিক আলোচনার ওপর। আর জনগণ অপেক্ষা করছে একটি অংশগ্রহণমূলক, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের।
বাংলাবার্তা/এমএইচ