
ছবি: সংগৃহীত
ভারতের দক্ষিণী চলচ্চিত্র অঙ্গনের জনপ্রিয় অভিনেতা এবং সাম্প্রতিক সময়ে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে ওঠা থালাপতি বিজয়ের এক জনসভা রক্তাক্ত ট্র্যাজেডিতে রূপ নিল। পদদলিত হয়ে প্রাণ হারালেন নারী ও শিশুসহ অন্তত ৩৬ জন মানুষ। মৃতদের মধ্যে রয়েছেন ১৬ জন নারী, আটজন শিশু এবং আরও কয়েকজন অজ্ঞাতপরিচয়। আহত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বহু মানুষকে নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছে চিকিৎসকরা। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।
শনিবার (২৭ সেপ্টেম্বর) রাতে ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের করুর শহরে এই ভয়াবহ ঘটনা ঘটে। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম দ্য হিন্দু দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, এটি ছিল থালাপতি বিজয়ের নেতৃত্বাধীন রাজনৈতিক দল তামিলাগা ভেট্রি কাজাগম (টিভিকে)-এর রাজ্য সফরের অংশ।
সূত্র জানিয়েছে, আয়োজকদের পক্ষ থেকে প্রায় ৩০ হাজার মানুষের জমায়েতের অনুমতি নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে জনসভাস্থলে জড়ো হয়েছিলেন প্রায় ৬০ হাজারের মতো মানুষ। অল্প জায়গায় অতিরিক্ত ভিড় জমে তৈরি হয় অস্বস্তিকর পরিস্থিতি। গরমে অসুস্থ হয়ে পড়তে শুরু করেন অনেকে। অনেকে অজ্ঞান হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, দীর্ঘক্ষণ অতিরিক্ত ভিড়ে আটকে থাকার ফলে অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়, যা পরবর্তী সময়ে পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তোলে।
সভা শুরু হওয়ার কথা ছিল দুপুরে। কিন্তু অভিযোগ, নির্ধারিত সময়ের প্রায় ছয় ঘণ্টা পর অর্থাৎ সন্ধ্যার দিকে সভাস্থলে পৌঁছান থালাপতি বিজয়। ততক্ষণে ভিড় নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। অসংখ্য ভক্ত তাকে একনজর দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিলেন। বিজয় মঞ্চে উঠেই বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। উপস্থিত ছিলেন স্থানীয় রাজনীতিক ও দলের নেতাকর্মীরাও। বক্তৃতার ফাঁকে তিনি ডিএমকের সাবেক মন্ত্রী সেন্থিল বালাজীকে কড়া ভাষায় সমালোচনা করছিলেন। ঠিক সেই মুহূর্তেই মঞ্চের সামনের ভিড়ে হঠাৎ হুড়োহুড়ি শুরু হয়।
প্রিয় তারকাকে কাছে থেকে দেখার জন্য অসংখ্য মানুষ একসঙ্গে মঞ্চের দিকে এগোতে থাকেন। ধাক্কাধাক্কির মধ্যে অনেকেই পড়ে যান মাটিতে। ভিড়ের চাপে পড়ে যাওয়া মানুষদের ওপর দিয়েই অন্যরা এগোতে থাকে। এর মধ্যেই ঘটে যায় প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা। চোখের সামনে ছোট ছোট শিশু অভিভাবকদের হাতছাড়া হয়ে যায়। আতঙ্কিত মানুষ চেষ্টা করেন নিজেদের রক্ষা করতে, কিন্তু ততক্ষণে এক ভয়াবহ পদদলনের ঘটনা রক্তাক্ত দৃশ্যের জন্ম দেয়।
করুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ আশপাশের কয়েকটি হাসপাতালে আহতদের নিয়ে যাওয়া হয়। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বহু মানুষের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। মৃতদেহগুলোর পরিচয় শনাক্তকরণের কাজ চলছে। নিহতদের পরিবার হাসপাতালে ছুটে এসে শোক ও আহাজারিতে ভেঙে পড়েন।
তামিলনাড়ুর মুখ্যমন্ত্রী এমকে স্ট্যালিন দ্রুত ঘটনাস্থলের খোঁজখবর নেন। তিনি নিহতদের পরিবারের প্রতি গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং ঘটনার তদন্তের নির্দেশ দেন। পাশাপাশি আহতদের দ্রুত চিকিৎসা নিশ্চিত করার জন্য স্থানীয় প্রশাসনকে নির্দেশনা দেন।
ভারতের রাষ্ট্রপতি দ্রৌপদী মুর্মু ও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ পৃথক বিবৃতিতে নিহতদের প্রতি শোক জ্ঞাপন করেন এবং আহতদের দ্রুত সুস্থতা কামনা করেন। কেন্দ্রীয় সরকার থেকেও ঘটনাটিকে গুরুত্ব দিয়ে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
দক্ষিণী সুপারস্টার থালাপতি বিজয় ইতোমধ্যে রাজনীতিতে প্রবেশ করে নতুন মাত্রা যোগ করেছেন তামিল রাজনীতিতে। তার দল টিভিকে রাজ্যজুড়ে সফর করছে এবং বিপুল জনসমর্থন পাচ্ছে। বিজয়ের রাজনৈতিক উত্থান তামিলনাড়ুর প্রথাগত রাজনৈতিক শক্তিগুলোর জন্যও চ্যালেঞ্জ হয়ে উঠেছে। কিন্তু করুরের এই ভয়াবহ পদদলনের ঘটনায় প্রশ্ন উঠেছে জননিরাপত্তা ও আয়োজকদের প্রস্তুতি নিয়ে।
পুরো তামিলনাড়ু রাজ্যে শোকের আবহ বিরাজ করছে। নিহতদের পরিবারের কাছে সান্ত্বনা পাঠানো হচ্ছে। বিজয় নিজেও গভীর শোক প্রকাশ করেছেন এবং নিহতদের পরিবারকে সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। তবে সমালোচকেরা বলছেন, আয়োজকদের অব্যবস্থাপনা ও তার বিলম্বিত উপস্থিতি এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ।
একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক মন্তব্য করেন, “বিজয়ের জনপ্রিয়তা অভূতপূর্ব, কিন্তু তার দলকে এখন জনসভা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিতে হবে। কারণ ভক্তদের ভিড় যখন বিপজ্জনক হয়ে ওঠে, তখন তা যে কোনো মুহূর্তে এমন মর্মান্তিক পরিণতি ডেকে আনতে পারে।”
এভাবেই প্রিয় অভিনেতাকে দেখতে গিয়ে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন ৩৬ জন নিরপরাধ মানুষ। আহতদের জীবন বাঁচাতে চলছে আপ্রাণ চেষ্টা। তামিলনাড়ুর মানুষ আজ শোকাহত, স্তব্ধ হয়ে আছে ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র ও রাজনৈতিক অঙ্গন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ