
ছবি: সংগৃহীত
মানুষের জীবনে সাফল্য বলতে আমরা সাধারণত বুঝি ধন-সম্পদ, পদ-পদবি, খ্যাতি বা ক্ষমতার উচ্চতা। সমাজে যার প্রভাব বেশি, তাকে সফল বলা হয়। কেউ রাষ্ট্রক্ষমতায় আসীন হলে বা কোটি কোটি টাকার মালিক হলে আমরা তাকে সম্মানের চোখে দেখি। অথচ বাস্তবতা হলো—এ সবই ক্ষণস্থায়ী। পৃথিবীর ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যেসব সম্রাট, রাজা-মহারাজা কিংবা ধনকুবেররা পৃথিবী শাসন করেছেন, একসময় সবাই মাটির নিচে সমাহিত হয়েছেন। ধন-সম্পদ, আভিজাত্য কিংবা প্রভাবশালী অবস্থান কেউই কবরে নিতে পারেনি।
মানবজীবনের সবচেয়ে কঠিন ও নির্ণায়ক দিন হলো কিয়ামতের দিন। কোরআন ও হাদিসে এ দিনের ভীতিকর চিত্র বারবার তুলে ধরা হয়েছে। কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন—“সেদিন ধন-সম্পদ কিংবা সন্তান কোনো কাজে আসবে না। কেবল সেই ব্যক্তি ছাড়া, যে আল্লাহর কাছে হাজির হবে কল্যাণময় অন্তর নিয়ে।” (সুরা আশ-শু‘আরা : ৮৮-৮৯)।
হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) কিয়ামতের দিনের ভয়াবহতা স্পষ্ট করে বলেছেন। তিনি উল্লেখ করেছেন, সেদিন সূর্য মানুষের মাথার একেবারে কাছে থাকবে। মানুষ হবে ঘামে সিক্ত, চারদিক অন্ধকারময়, কারো পাশে কারো কোনো সাহায্য থাকবে না। কোনো ছায়া থাকবে না—শুধু আল্লাহর আরশের ছায়া ছাড়া। আর সেই ছায়ায় থাকবেন কিছু বিশেষ বান্দা, যারা তাদের আমল ও ঈমানের কারণে আল্লাহর প্রিয় হয়েছেন।
বুখারি শরিফের বিখ্যাত একটি হাদিসে (হাদিস : ৬৬০) রাসুলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট করে বলেছেন—“সাত শ্রেণির মানুষকে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তাঁর আরশের ছায়ায় রাখবেন, সেদিন আল্লাহর ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না।”
১. ন্যায়পরায়ণ শাসক
শাসনক্ষমতা মানুষের জন্য এক বিরাট পরীক্ষা। ইতিহাসে দেখা যায়, বেশিরভাগ ক্ষমতাবান ব্যক্তি অন্যায়ের পথ বেছে নিয়েছেন। শাসনব্যবস্থাকে করেছেন স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার। কিন্তু যারা আল্লাহভীরু থেকে ন্যায় প্রতিষ্ঠা করেন, তারা আল্লাহর সবচেয়ে প্রিয় বান্দা। কিয়ামতের দিন তারা পাবেন আল্লাহর আরশের ছায়া। আজকের দিনে সেটা রাষ্ট্রপ্রধান হতে পারে, আবার ছোট কোনো প্রতিষ্ঠানের কর্তাও হতে পারেন। যদি ক্ষমতার আসনে থেকেও ন্যায়ের মানদণ্ডে অবিচল থাকেন, তবে তার জন্য রয়েছে এই মহৎ পুরস্কার।
২. যে যুবক আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে ওঠে
যৌবন হলো জীবনের সবচেয়ে উচ্ছ্বাসময় সময়। এই বয়সে মানুষ ভোগ-বিলাস, পাপাচার ও নানান প্রলোভনের দিকে সহজেই ঝুঁকে পড়ে। অথচ যে যুবক আল্লাহর ইবাদতে বেড়ে ওঠে, আল্লাহভীতিকে আঁকড়ে ধরে জীবন কাটায়, সে হবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা। মহানবী (সা.) বলেন, “কিয়ামতের দিনে মানুষের দুই পা সরবে না, যতক্ষণ না সে পাঁচটি বিষয়ে হিসাব দেয়—জীবন, যৌবন, সম্পদ, জ্ঞান ও আমল।” (তিরমিজি, হাদিস : ২৪১৬)।
৩. যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে
মসজিদ হলো আল্লাহর ঘর। যে বান্দার অন্তর মসজিদের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে, যে বারবার মসজিদে আসে, নামাজ পড়ে, সে আসলে আল্লাহর ঘরের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। মসজিদপ্রেমী এ মানুষদের জন্যও রয়েছে কিয়ামতের দিনে আরশের ছায়া।
৪. দুই ব্যক্তি, যারা আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসে
ভালোবাসার সম্পর্ক সাধারণত রক্তের সম্পর্ক, পার্থিব স্বার্থ কিংবা অন্য কোনো প্রয়োজন থেকে হয়। কিন্তু যারা নিছক আল্লাহর জন্য একে অপরকে ভালোবাসে, তাদের ভালোবাসা দুনিয়ার যেকোনো বন্ধনের চেয়ে দৃঢ়। তারা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য মিলিত হয় এবং বিচ্ছিন্ন হয়। কিয়ামতের দিনে এই সম্পর্কই তাদেরকে আরশের ছায়ায় আশ্রয় দেবে।
৫. যে মানুষকে কোনো সৌন্দর্যময় নারী ব্যভিচারে আহ্বান করলে সে বলে, “আমি আল্লাহকে ভয় করি”
পাপের আহ্বান যদি আকর্ষণীয় কোনো রূপে আসে, তখন সেটি প্রতিহত করাই প্রকৃত তাকওয়া। হজরত ইউসুফ (আ.)-এর ঘটনা এ ক্ষেত্রে বড় উদাহরণ। আজকের যুগে যখন সর্বত্র অশ্লীলতার বিস্তার ঘটেছে, তখন যে যুবক বা ব্যক্তি আল্লাহভীতির কারণে পাপ থেকে বিরত থাকে, সে হবে আল্লাহর প্রিয় বান্দা।
৬. যে গোপনে দান করে, এমনকি তার বাঁ হাতও জানে না ডান হাত কী দান করছে
দান-সদকা ইসলামে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমল। তবে দানের মূল উদ্দেশ্য হতে হবে আল্লাহর সন্তুষ্টি। যারা দান করে প্রচারের জন্য নয়, বরং গোপনে করে যাতে অন্য কেউ টেরও পায় না—তাদের জন্য রয়েছে আল্লাহর বিশেষ কৃপা। কোরআনে বলা হয়েছে—“তোমরা যদি প্রকাশ্যে সদকা দাও, তা ভালো; আর যদি তা গোপনে দিয়ে গরিবদের পৌঁছাও, তবে তা তোমাদের জন্য আরও উত্তম।” (সুরা বাকারাহ : ২৭১)।
৭. যে একান্তে আল্লাহকে স্মরণ করে চোখের অশ্রু ঝরায়
মানুষের ভিড়ে নয়, বরং একান্ত নির্জনে যখন কেউ আল্লাহকে স্মরণ করে কাঁদে, তখন তা প্রমাণ করে তার ঈমান কতটা দৃঢ়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন—“দুটি চোখকে আগুন স্পর্শ করবে না; একটি হলো সেই চোখ, যা আল্লাহভীতিতে কেঁদেছে।” (তিরমিজি, হাদিস : ১৬৩৯)।
দুনিয়ার সাফল্য যত বড়ই মনে হোক, তা ক্ষণস্থায়ী। প্রকৃত সাফল্য হলো কিয়ামতের দিনে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা এবং আরশের ছায়ায় আশ্রয় পাওয়া। এই সাত শ্রেণির মানুষ আমাদের জন্য আদর্শ। আল্লাহ তাআলা আমাদেরও তাওফিক দিন, যেন আমরা নিজ নিজ অবস্থান থেকে আমল করে আরশের ছায়ায় স্থান পাওয়ার যোগ্য হই। আমিন।
বাংলাবার্তা/এমএইচ