
ছবি: সংগৃহীত
উচ্চ রক্তচাপ বা হাইপারটেনশন নামটি শুনলে বেশিরভাগ মানুষের মনে প্রথমেই আসে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক বা কিডনির সমস্যা—এইসব ভয়ের চিত্র। কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যা অনেক সময় আলোচনার বাইরে থেকে যায়, সেটি হলো—চোখ। উচ্চ রক্তচাপ শুধু হার্ট নয়, আমাদের দৃষ্টিশক্তির উপরও মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। চিকিৎসকদের মতে, দীর্ঘমেয়াদি অনিয়ন্ত্রিত হাইপারটেনশন চোখের একাধিক জটিলতা তৈরি করতে পারে, যার মধ্যে একটি হলো ‘চোখের স্ট্রোক’। এমনকি একপর্যায়ে চিরতরে দৃষ্টিশক্তিও হারিয়ে যেতে পারে।
চোখে স্ট্রোক কীভাবে হয়?
চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. সুমন মুখোপাধ্যায় জানিয়েছেন, "উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখের রেটিনায় থাকা শিরা ও ধমনীগুলোতে রক্ত চলাচল ব্যাহত হতে পারে। অনেক সময় এর ফলে তৈরি হয় ব্লকেজ, যার চিকিৎসা না হলে ‘সেন্ট্রাল রেটিনাল ভেইন অকুলেশন’ (CRVO) নামে পরিচিত একটি জটিল অবস্থা দেখা দেয়। এটাই সাধারণভাবে চোখের স্ট্রোক হিসেবে পরিচিত।"
CRVO হলে রেটিনায় রক্ত জমাট বেঁধে দৃষ্টিশক্তি হঠাৎ করে কমে যেতে পারে। চোখের ভিতরে রক্তপাত হতে পারে এবং চোখে কালো দাগ বা ঝুলের মতো অন্ধকার দেখা দিতে পারে। রোগী অনেক সময় চোখের সামনে ছায়ার মতো আবছা কিছু দেখতে পান, যা আসলে রক্তপাতের লক্ষণ।
CRVO-এর ভয়াবহতা ও চিকিৎসা
চোখের এই অবস্থা যদি অবহেলা করা হয়, তাহলে তা থেকে স্থায়ী দৃষ্টিশক্তি হ্রাস বা সম্পূর্ণ অন্ধত্বও হতে পারে। ডা. মুখোপাধ্যায় জানান, “এই রোগের চিকিৎসা হিসেবে চোখে ইনজেকশন দেওয়া হয় এবং প্রয়োজনে রেটিনাল লেজার থেরাপিও করা হয়।” তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা। কারণ, যতক্ষণ না মূল কারণটি নিয়ন্ত্রণে আসে, ততক্ষণ চিকিৎসা দিয়ে সাময়িক উপশম মিললেও পুরোপুরি আরোগ্য লাভ কঠিন হয়ে পড়ে।
হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি: চোখের ভিতরের নীরব ঘাতক
আরও একটি মারাত্মক জটিলতা হলো ‘হাইপারটেনসিভ রেটিনোপ্যাথি’। এই সমস্যায় রক্তচাপ এতটা বেড়ে যায় যে চোখের অপটিক নার্ভ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রেটিনার রক্তনালীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যায়, যার ফলে চোখে রক্তপাত হয় এবং ধীরে ধীরে দৃষ্টিশক্তি নষ্ট হতে শুরু করে। চিকিৎসা না করলে এই ক্ষতি অনেক সময় স্থায়ী হয়ে যেতে পারে।
অন্তঃসত্ত্বা নারীদের জন্য আরও বেশি ঝুঁকি
গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রে হাইপারটেনশন আরও বিপজ্জনক রূপ নেয়। অনেক সময় গর্ভাবস্থায় রক্তচাপ হঠাৎ বেড়ে গেলে তা ‘প্রেগন্যান্সি হাইপারটেনশন’ বা ‘একলাম্পসিয়া’ রূপ নেয়। একলাম্পসিয়ার আগে বা সময়ে চোখে প্রভাব পড়তে পারে। চোখ ঝাপসা দেখা, দৃষ্টিশক্তি হ্রাস পাওয়া—এই লক্ষণগুলো একলাম্পসিয়ার গুরুতর অবস্থার পূর্বাভাস হিসেবে গণ্য করা হয়। ডা. মুখোপাধ্যায় বলেন, “এই লক্ষণগুলোকে অবহেলা করা বিপজ্জনক। এমন সময় দ্রুত চিকিৎসা শুরু না করলে মা ও শিশু উভয়ের জীবন হুমকির মুখে পড়তে পারে।”
অস্ত্রোপচারের সময় হাইপারটেনশন নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব
চোখের বা যে কোনো ধরনের অস্ত্রোপচারের সময় রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা অত্যন্ত জরুরি। অনিয়ন্ত্রিত রক্তচাপ নিয়ে সার্জারি করলে অপারেশনের সময় বা পরে চোখে রক্তপাত হতে পারে, যা পুরো চোখকেই নষ্ট করে দিতে পারে। অনেক সময় অপারেশন সফল হলেও রক্তচাপের প্রভাবে চোখের ভেতরে ক্ষয়ক্ষতি এতটাই বেশি হয় যে রোগীর দৃষ্টিশক্তি আর ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না।
করণীয় কী?
নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ করা এবং চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ গ্রহণ করা
চোখে ঝাপসা দেখা, হঠাৎ দৃষ্টি কমে যাওয়া বা চোখে কালো দাগ দেখলে অবিলম্বে চক্ষু চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া
গর্ভবতী নারীদের নিয়মিত প্রেশার মনিটর করা এবং চোখে সমস্যার লক্ষণ দেখা দিলে গুরুত্ব সহকারে নেওয়া
যেকোনো অস্ত্রোপচারের আগে রক্তচাপ পরীক্ষা ও নিয়ন্ত্রণ করা
উচ্চ রক্তচাপকে অনেকেই হার্ট বা কিডনির জন্য বিপজ্জনক ভাবেন, কিন্তু চোখের বিষয়টি প্রায়শই এড়িয়ে যান। অথচ চোখের ক্ষতি একবার হলে তা ফেরানো অনেক সময় সম্ভব হয় না। তাই হাইপারটেনশনকে অবহেলা না করে নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও সতর্কতা অবলম্বনই পারে আপনার চোখের আলো রক্ষা করতে। শুধু শরীর নয়, দৃষ্টি রক্ষাতেও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ