
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের জন্য গৌরবজনক একটি অর্জন এসেছে বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ চলচ্চিত্র আসর থেকে। ৭৮তম কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে বিশেষ উল্লেখযোগ্য ছবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে তরুণ নির্মাতা আদনান আল রাজীব পরিচালিত স্বল্পদৈর্ঘ্য বাংলা সিনেমা ‘আলী’। কানের এই বিভাগে দেওয়া হয় ‘স্পেশাল মেনশন’, যা বিশেষভাবে প্রশংসিত চলচ্চিত্রের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়।
সিনেমাটি ২২ মে বৃহস্পতিবার কানের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগের অফিসিয়াল স্ক্রিনিংয়ে প্রদর্শিত হয়। প্রদর্শনী শেষে দর্শক, সমালোচক ও বিচারকদের কাছ থেকে ব্যাপক প্রশংসা পায় ‘আলী’। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা আসে যে, সিনেমাটি ‘Special Mention’ অর্জন করেছে, যা বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনের জন্য একটি বড় অর্জন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
উপকূলের এক কিশোরের গান গাওয়া—প্রতিবাদের প্রতীক
‘আলী’ সিনেমার কাহিনি আবর্তিত হয়েছে বাংলাদেশের উপকূলীয় এক প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রেক্ষাপটে। ছবির প্রধান চরিত্র আলী, এক কিশোর, যে বেড়ে উঠছে একটি রক্ষণশীল সমাজে—যেখানে নারীদের গান গাওয়া নিষিদ্ধ, এবং শিল্পচর্চাকে লজ্জাজনক বলে মনে করা হয়। অথচ এই পরিবেশেই আলী নিজের নাম লেখাতে চায় একটি গানের প্রতিযোগিতায়।
এই সরল আকাঙ্ক্ষার আড়ালে রয়েছে এক জটিল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দ্বন্দ্ব। সেখানে প্রশ্ন উঠে—কে গান গাইতে পারে, কারা পারে না? কেন নারী কণ্ঠকে নিরুৎসাহিত করা হয়? এই প্রশ্নগুলোর ভেতর দিয়ে সিনেমাটি তুলে ধরে সমাজে প্রচলিত লিঙ্গবৈষম্য, সংস্কার, এবং ব্যক্তি স্বাধীনতার সংকীর্ণ সীমানা।
নির্মাতা আদনান আল রাজীব এ সিনেমায় পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধকে নরম ভঙ্গিতে চ্যালেঞ্জ করেছেন। তবে সরাসরি কোনো রাজনৈতিক ভাষ্য নয়, বরং এক কিশোরের শিল্পের প্রতি আগ্রহকে কেন্দ্র করেই দর্শককে ভাবতে বাধ্য করেছেন—এই সমাজে একটুকু স্বপ্ন দেখা কি সত্যিই এত কঠিন?
অভিনয়ে আল-আমিন, নাম ভূমিকাতেই
সিনেমাটির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন আল-আমিন, যিনি নিজের স্বনামেই পর্দায় হাজির হয়েছেন। একজন সাধারণ কিশোরের সরল ও নিষ্পাপ আকাঙ্ক্ষার ভেতর দিয়ে আল-আমিন তার চরিত্রে এনেছেন প্রাণ। চলচ্চিত্রটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তার অনুভূতির অভিব্যক্তি, নিঃশব্দ প্রতিবাদ, ও সাহসী সিদ্ধান্তের ওপর দাঁড়িয়ে।
নির্মাণ ও প্রস্তুতির পেছনের গল্প
পরিচালক আদনান আল রাজীব দেশের বিজ্ঞাপন নির্মাণ জগতে এক পরিচিত নাম। দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তিনি নির্মাণে যুক্ত। তবে ‘আলী’ তার অন্যতম আবেগী ও চ্যালেঞ্জিং কাজ, যা কেবল বিজ্ঞাপনের পাটাতন ছাড়িয়ে একটি আন্তর্জাতিক মানের সিনেমা হয়ে উঠেছে।
তিনি জানান, গত বছরের ডিসেম্বরে সিলেট অঞ্চলের বিভিন্ন লোকেশনে ‘আলী’র শুটিং সম্পন্ন হয়। টানা পাঁচদিন ধরে চলে চিত্রগ্রহণের কাজ। শুটিংকালীন প্রতিটি মুহূর্তে একটিই ভাবনা কাজ করেছে—‘এই গল্পটা যেন হৃদয় ছুঁয়ে যায়’।
আদনান বলেন, “এই ছবিটা মূলত আমরা একটা অভিনব ভাবনা মাথায় রেখে বানিয়েছিলাম। আমরা কখনোই ভাবিনি এটা কান চলচ্চিত্র উৎসব পর্যন্ত যাবে। এটা যেন স্বপ্নের মতো।”
কান উৎসবে অংশগ্রহণ—বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত
আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র এখনও তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকলেও, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিক তরুণ নির্মাতা দেশীয় সিনেমাকে এক নতুন দিগন্তে নিয়ে যাচ্ছেন। তাদের মধ্যে আদনান আল রাজীবের নামটি এই অর্জনের মাধ্যমে আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
কানের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ‘আলী’ সম্পর্কে বলা হয়েছে—“এটি এমন এক উপকূলীয় শহরের গল্প, যেখানে নারীদের গান গাইতে দেওয়া হয় না। অথচ সেই সমাজেই এক কিশোর গান গেয়ে শহরের দিকে যেতে চায়। তবে সেই গানের ভেতর লুকিয়ে রয়েছে এক গভীর রহস্য।”
এই ধরনের চিত্রনাট্য, যেখানে ক্ষুদ্র একটি সম্প্রদায়ের অভ্যন্তরীণ সংস্কৃতি নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়, সেগুলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবগুলোতে প্রায়ই উচ্চ প্রশংসিত হয়। ‘আলী’ও ব্যতিক্রম নয়।
দেশের বাইরে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল
সিনেমাটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রমাণ করে, সাহসী ও মানবিক গল্প বলার শক্তিই এক দেশকে বিশ্বমঞ্চে তুলে আনতে পারে। স্বল্পদৈর্ঘ্য হলেও ‘আলী’ তার আবেগ, বার্তা, এবং নির্মাণশৈলীর মাধ্যমে অনেক বড় একটি কথা বলে গেছে—প্রথা ভাঙার জন্য অনেক সময় প্রয়োজন পড়ে এক শিশুর সহজ স্বপ্ন।
বিশ্ব চলচ্চিত্রের গুরুত্বপূর্ণ আসর কানে এমন স্বীকৃতি পাওয়া বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত মর্যাদার। এটি শুধু আদনান আল রাজীবের নয়, বরং বাংলাদেশের নতুন প্রজন্মের সব নির্মাতাদের জন্য এক অনুপ্রেরণা।
‘আলী’র এই অর্জন হয়তো ভবিষ্যতে আরও অনেক সাহসী গল্প বলার দুয়ার খুলে দেবে, যেখানে বাংলাদেশের মানুষের জীবনের বাস্তবতা, স্বপ্ন আর প্রতিবাদ আন্তর্জাতিক দর্শকের সামনে আরও স্পষ্টভাবে উঠে আসবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ