ছবি: বাংলাবার্তা
সততা, আমনতদারিতা মানুষকে কোথায় নিয়ে পৌঁছায় এর জ্বলন্ত উদাহরণ প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবি হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.)। আমরা সাহাবিদের শুধু কষ্ট আর যন্ত্রণার কথা, অনাহার আর অর্ধাহারের গল্পই শুনে আসছি। অথচ সাহাবিদের মাঝেও কোটিপতি সাহাবি ছিলেন।
প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাহাবিগণ ছিলেন তাদের জীবনে বিজয়ী ও সফল। তারা ছিলেন আত্মনির্ভরশীল ও ব্যবসায়ী। তবে তারা দুনিয়ার সফলতা ও ধনাঢ্যতাকে হৃদয়ে স্থান দেননি। বরং তাদের হৃদয়-আত্মা জুড়ে ছিল শুধুই আল্লাহ ও তাঁর রাসুলের ভালোবাসায় টইটম্বুর।
ইসলামের শুরুর দিকে সাহাবি আবদুর রহমান বিন আওফ (রা.) ইসলাম গ্রহণ করেন। প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর সিদ্দিক (রা.)-এর দাওয়াতে যারা মুসলমান হয়েছেন- তিনি তাদের অন্যতম। তার জন্ম ৫৮১ খ্রিষ্টাব্দে কোরাইশের বনু জোহরা গোত্রে। তিনি বয়সে প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ১০ বছরের ছোট। ইসলাম গ্রহণের আগে তার নাম ছিল আবদে আমর বা আবদুল কাবা। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর নাম পরিবর্তন করে রাখেন আবদুর রহমান।
বিখ্যাত সাহাবি হজরত আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) জীবনের শুরুতে ছিলেন মক্কার একজন স্বনামধন্য ব্যবসায়ী। তাঁর বাবাও ছিলেন একজন সফল ব্যবসায়ী। বাবা তাঁর মাঝে দেখেছিলেন সফল ব্যবসায়ী হওয়ার সকল গুণ। বাবার ধারণাকে সত্য পরিণত করতে খুব বেশি বেগ পেতে হয়নি। অল্প সময়ের ব্যবধানে হয়ে উঠেছিলেন সেই সময়ের ব্যবসায়ীদের আইকন। প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের ঘোষণা দিলে তিনি মদিনাতে শরণার্থী হিসেবে যান। নিজের অঢেল সম্পত্তি মক্কাতে ফেলে রেখে যান। কিন্তু তিনি বিচলিত হননি। নিজের উপর বিশ্বাস ছিল আকাশচুম্বী।
‘মদিনার বাজার দেখিয়ে দিন’
মদিনা হিজরতের পর প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে সাদ ইবনে রাবিয়া (রা.)-এর সঙ্গে ভ্রাতৃত্বের সম্পর্ক করে দেন। সাদ ইবনে রাবিয়া (রা.) তাকে ডেকে বললেন, ‘আনসারদের সবাই জানে, আমি একজন ধনী ব্যক্তি। আমি আমার সব সম্পদ সমান দুইভাগ করে আপনাকে একভাগ দিতে চাই। আর আমার দুইজন স্ত্রী আছে। তাদের যাকে আপনার পছন্দ হয় আমি তাকে তালাক দেব। তারপর আপনি তাকে বিবাহ করে নেবেন। ’ কিন্তু আবদুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) বললেন, ‘আল্লাহ আপনার পরিবার ও সম্পদে বরকত দান করুন। ভাই, আমার এসব কোনো কিছুর প্রয়োজন নেই। আমাকে শুধু মদিনার বাজারটি দেখিয়ে দিন। ’
মদিনার বাজারে তিনি মাত্র দুই কি চার দিনার নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন। তিনি প্রথমে ঘি আর পনিরের ব্যবসা শুরু করেন। এরপরে তিনি বুঝতে পারলেন বাজারে ঘোড়ার চাহিদা বেশ। সাথে সাথে তিনি ঘোড়া বেচা-কেনার ব্যবসায় হাত দিলেন। এর কিছু দিন পরে লাভের সন্ধান পেয়ে ঘোড়ার জিনের ব্যবসায়ে হাত প্রসার করেন। অল্পদিনের ব্যবধানে তাঁর ব্যবসায়ের বেশ প্রসার ঘটে। তিনি ব্যবসায়ী মহলে এতোটাই পরিচিত হয়ে উঠেন যে এমনকি যদি তিনি একটি পাথরও তুলতেন, আশা করা হতো তার নিচে স্বর্ণ পাওয়া যাবে!
আরও পড়ুন : পবিত্র রমজানের ৫ প্রস্তুতি
দান করাই তাঁর নেশা
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) ব্যবসায় প্রাপ্ত মুনাফার বিপুল অংশ দান করতেন। এমনকি কখনো কখনো তাঁর ব্যবসার মূলধন থেকেও দান করতেন। একবার সিরিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য নিয়ে তার একটি বাণিজ্য কাফেলা মদিনায় আসে। ৭০০ উটের পিঠে মালপত্র বোঝাই ছিল। পুরো মদিনায় রব পড়ে যায়। উম্মুল মুমিনিন হজরত আয়শা (রা.) বললেন, ‘আমি প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, আবদুর রহমান জান্নাতে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করবে। ’ আয়শা (রা.)-এর এ কথা আবদুর রহমানের কানে গেল। তিনি বললেন, ‘হে জননী! আমি এ বিশাল বাণিজ্য সম্ভার আল্লাহর রাস্তায় দান করে দিলাম। ’ (উসদুল গাবাহ)
বিখ্যাত সাহাবি আনাস (রা.) বলেন, আমি প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, ‘আমার উম্মতের মধ্যে সর্বপ্রথম (ধনী হিসেবে) জান্নাতে প্রবেশ করবেন আবদুর রহমান বিন আওফ। তিনি হামাগুড়ি দিয়ে জান্নাতে প্রবেশ করবেন। ’ (মুসনাদে বাজ্জার : ৭০০৩)
ইবনে হাজার (রহ.) আল-ইসাবা গ্রন্থে উল্লেখ করেন, আবদুর রহমান বিন আওফ (রা.) মোট ৩০ হাজার দাস মুক্ত করেছেন। আল্লাহর রাস্তায় ৪০ হাজার দিনার, ৫০০ ঘোড়া এবং ৫০০ বাহন দান করেছেন। (উসদুল গাবাহ)
তাঁর ব্যবসায়িক নীতি
আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) যেসব নীতি মেনে সাফল্যের উচ্চ শিখরে আরোহণ করেছিলেন-
১. তিনি পণ্য নগদে কিনতেন এবং নগদে বিক্রি করতেন।
২. কখনোই বেশি লাভের আশায় অপেক্ষা করতেন না- পণ্য মজুদও করতেন না। সামান্য লাভ হলেও তিনি পণ্য বিক্রি করে দিতেন।
৩. নিজের পণ্যে সামান্য পরিমাণ খুঁত থাকলেও তা তিনি খরিদদারের কাছে প্রকাশ করে দিতেন।
এই তিন নীতিই তাকে এতো পরিমাণ সম্পদ লাভে সহায়তা করেছিল।
মাত্র দু–চার দিনার দিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলেন। মদিনায় হিজরতের প্রায় ৩০ বছর জীবিত ছিলেন তিনি। এই ৩০ বছরে ব্যবসা করে আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) আজকের বাজার মূল্যে কয়েক শ কোটি টাকা উপার্জন করেন!
মৃত্যুর পূর্বে তাঁর নগদ সম্পদের পরিমাণ
আবদুর রহমান ইবনে আউফ (রা.) যখন ইন্তেকাল করেন, তখন তাঁর সম্পদের পরিমাণ ছিল- ১০০টি উট, ৩০০০ ভেড়া, ১০০ ঘোড়া জমিতে পানি দেওয়ার জন্য ২০টি উট এবং ১৯ লক্ষ ২০ হাজার দিরহাম রেখে যান; যা দিয়ে ১ লাখ ৬০ হাজার ভেড়া কেনা যেত। ১০,০০০ টাকা ভেড়ার মূল্য ধরলে তাঁর রেখে যাওয়া নগদ অর্থের মূল্য দাঁড়ায় ১৬০ কোটি টাকা।
আজকে আমার সামান্য সম্পদ অর্জন করতে গিয়ে নামাজ, রোজা ছেড়ে দেই। অথচ আব্দুর রহমান ইবনে আওফ (রা.) এত সম্পদ উপার্জন করতে গিয়ে নামাজ-রোজা ছাড়েননি। বরং প্রিয় নবীজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে প্রায় সব যুদ্ধে অংশ নেন। কোটি কোটি টাকার সম্পদ তাকে প্রভাবিত ও প্রতারিত করতে পারেনি। এ কারণেই দুনিয়াতে থাকতে তিনি জান্নাতের সুসংবাদ পান।
মৃত্যু
কোটিপতি জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত এ সাহাবি ৩১ হিজরি মতান্তরে ৩২ হিজরিতে মদিনায় মৃত্যুবরণ করেন। মৃত্যুকালে তার বয়স ছিল ৭৫ বছর। তাকে মদিনার জান্নাতুল বাকিতে দাফন করা হয়। জানাযায় ইমামতি করেন ওসমান বিন আফফান (রা.)।
বাংলাবার্তা/জেডএইচ