
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আগামী জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে যখন নানা ধরনের সমীকরণ তৈরি হচ্ছে, ঠিক সেই সময় নিজেদের অবস্থান আরও দৃঢ়ভাবে জানান দিতে মাঠে নেমেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দলটি তাদের দাবি-দাওয়া স্পষ্ট করে তুলতে এবং জনমত গড়ে তুলতে তিনদিনব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। সেই কর্মসূচির অংশ হিসেবেই আজ শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ মিছিল আয়োজন করেছে জামায়াত।
এই বিক্ষোভ কর্মসূচিকে ঘিরে ইতোমধ্যেই দেশজুড়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে এটি কেবল একটি রাজনৈতিক দলীয় কর্মসূচি নয়, বরং সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করার প্রচেষ্টা বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
জামায়াতের ঘোষিত তিনদিনের কর্মসূচি শুরু হয় বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) রাজধানীতে। বিকেল সাড়ে ৪টায় বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের দক্ষিণ গেটে ঢাকা মহানগরী উত্তর ও দক্ষিণ জামায়াত যৌথভাবে বিক্ষোভ মিছিলের আয়োজন করে। এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন দলের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মো. তাহের। বিশেষ অতিথি হিসেবে যোগ দেন দলের সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
আজ শুক্রবার কর্মসূচির দ্বিতীয় দিন সাতটি বিভাগীয় শহরে বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হবে। এরপর আগামী ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের সব জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে একই দাবিতে কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দিয়েছে জামায়াত। এতে করে বলা যায়, দলটি ধাপে ধাপে কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কর্মসূচি বিস্তার করতে চাইছে।
আজকের কর্মসূচি প্রতিটি বিভাগীয় শহরে অনুষ্ঠিত হবে এবং সেগুলোর নেতৃত্ব দেবেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতারা।
-
বরিশালে নেতৃত্ব দেবেন দলের নায়েবে আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান।
-
রংপুরে থাকবেন সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার।
-
চট্টগ্রামে নেতৃত্ব দেবেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান।
-
সিলেটে কর্মসূচি পরিচালনা করবেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড. এ এইচ এম হামিদুর রহমান আজাদ।
-
রাজশাহীতে থাকবেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট মুয়াযযম হোসাইন হেলাল।
-
মোমেনশাহী (ময়মনসিংহে) নেতৃত্ব দেবেন সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের।
-
খুলনায় নেতৃত্ব দেবেন কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও দলের প্রচার ও মিডিয়া বিভাগের সেক্রেটারি অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ।
এমনভাবে প্রতিটি বিভাগে কেন্দ্রীয় পর্যায়ের শীর্ষ নেতাদের সরাসরি সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে দলটি আসলে তাদের সাংগঠনিক শক্তি প্রদর্শন করতে চাইছে বলেই ধারণা করা হচ্ছে।
জামায়াতে ইসলামী তাদের ঘোষণায় বলছে, তারা জনগণের ভোটাধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলন চালাচ্ছে। দলের মতে, বর্তমান সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। তাই তারা বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে ‘জুলাই জাতীয় সনদ’কে ভিত্তি করে আগামী জাতীয় নির্বাচন আয়োজন এবং সংসদ নির্বাচনে প্রোপোরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (PR) পদ্ধতি চালুর দাবি তুলেছে।
তাদের পাঁচ দফা দাবি হলো—
১. জুলাই জাতীয় সনদের ভিত্তিতে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে জাতীয় নির্বাচন আয়োজন।
২. জাতীয় সংসদের উভয় কক্ষে পিআর পদ্ধতি চালু করা।
৩. সবার জন্য সমান সুযোগ রেখে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করা।
৪. সরকারের ‘জুলুম-নির্যাতন, গণহত্যা ও দুর্নীতি’র বিচার করা এবং তা দৃশ্যমান করা।
৫. স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টি ও ক্ষমতাসীন ১৪ দলের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করা।
জামায়াতের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, সাত বিভাগে আজকের কর্মসূচিকে ঘিরে ইতোমধ্যেই মাঠ পর্যায়ে কর্মীদের সক্রিয় করা হয়েছে। শুধু রাজধানী নয়, বিভাগীয় শহরগুলোতেও ব্যাপক প্রচারণা চালানো হয়েছে। প্রচারপত্র, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এবং স্থানীয় সংগঠনের মাধ্যমে কর্মসূচির প্রতি জনগণের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে দলটি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জামায়াত শুধু দাবি জানানোর জন্য নয়, বরং শক্তি প্রদর্শন এবং কর্মীদের মাঠে ধরে রাখার জন্য এই কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। আসন্ন নির্বাচনের আগে নিজেদের সংগঠনিক উপস্থিতি এবং জনসমর্থন প্রদর্শন করাটাই দলটির মূল উদ্দেশ্য।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি। দলের নিবন্ধন বাতিল হওয়া, রাজনৈতিক কার্যক্রমে নানা বাধা এবং নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা-মোকদ্দমা চলমান থাকা সত্ত্বেও তারা মাঠে সক্রিয় থাকতে চাইছে। নির্বাচনের আগে এ ধরনের ধারাবাহিক কর্মসূচির মাধ্যমে দলটি নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করতে চাইছে।
২৬ সেপ্টেম্বর জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে বিক্ষোভের ঘোষণা দিয়ে জামায়াত আসলে বোঝাতে চাইছে, তাদের আন্দোলন কেবল শহরকেন্দ্রিক নয়, বরং তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। এ ছাড়া দলীয় নেতারা আশা করছেন, জনগণের অংশগ্রহণ যত বাড়বে, সরকার তাদের দাবির প্রতি ততটা বাধ্য হবে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, সাত বিভাগে আজকের বিক্ষোভ কেবল দলীয় শক্তি প্রদর্শনের কর্মসূচি নয়, বরং আগামী নির্বাচনকে ঘিরে সামগ্রিক পরিস্থিতিতে চাপ সৃষ্টির একটি কৌশল। অন্যদিকে সরকার ও প্রশাসনের দিক থেকেও এ কর্মসূচির ওপর কড়া নজর রাখা হচ্ছে বলে জানা গেছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ