
ছবি: সংগৃহীত
মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা যখন প্রতিদিনই নতুন রূপ নিচ্ছে, তখন কাতারের রাজধানী দোহায় ঘটে যাওয়া এক রহস্যময় হামলার পর প্রথমবারের মতো প্রকাশ্যে এলেন ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য গাজী হামেদ। ইসরাইলের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হওয়া সত্ত্বেও প্রাণে বেঁচে যাওয়া এই শীর্ষ নেতার সাক্ষাৎকার এখন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
গত সপ্তাহে (৯ সেপ্টেম্বর) দোহায় হামাস নেতাদের হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা চালায় ইসরাইল। শীর্ষ নেতারা অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও অন্তত ৬ জন নিহত হন। ঘটনার পর বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিলেও হামাস নেতৃত্ব নীরব ছিল। অবশেষে ১৭ সেপ্টেম্বর, আল জাজিরাকে দেওয়া এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে হামাস নেতা গাজী হামেদ নিজের অভিজ্ঞতা, রাজনৈতিক অবস্থান এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা খোলাখুলি তুলে ধরেন।
গাজী হামেদ সাক্ষাৎকারে জানান, হামলা কোনো সাধারণ আক্রমণ ছিল না; এটি ছিল সুপরিকল্পিত হত্যার চেষ্টা। তিনি বলেন, “আমরা যুদ্ধ শেষ করার জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করতে বসেছিলাম। বৈঠক শেষ হওয়ার এক ঘণ্টারও কম সময় পর হঠাৎ আমরা বিস্ফোরণের শব্দ শুনি। আমরা গাজার মানুষ, তাই সহজেই বুঝতে পারি—এটি কোনো দুর্ঘটনা নয়, বরং হত্যার চেষ্টা।”
হামেদ আরও বলেন, তারা সঙ্গে সঙ্গে প্রাণ বাঁচাতে পালানোর চেষ্টা করেন এবং সৌভাগ্যক্রমে সফল হন। তার ভাষায়, “আমরা জানি কিভাবে মৃত্যুর শব্দ আলাদা করতে হয়। দোহাতেও সেই শব্দ শুনে বুঝে গিয়েছিলাম, আমরা লক্ষ্যবস্তু হয়েছি।”
হামেদ দাবি করেন, ইসরাইল শুধু হামাস নয়, পুরো ফিলিস্তিনি জাতিকেই লক্ষ্যবস্তু করেছে। তিনি বলেন, “আমরাই একমাত্র লক্ষ্য নই, পুরো জাতিই লক্ষ্যবস্তু। ইসরাইলের কোনো লাল রেখা নেই। নেতানিয়াহু বারবার মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা পাল্টে দেওয়ার কথা বলেন। এর জবাব দিতে হলে আরব বিশ্বের ঐক্যবদ্ধ প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন।”
তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়, হামাস ইসরাইলি আক্রমণকে নিছক সামরিক লড়াই হিসেবে দেখছে না; তারা এটিকে ফিলিস্তিনি অস্তিত্বের বিরুদ্ধে এক বৃহৎ ষড়যন্ত্র হিসেবে বিবেচনা করছে।
আলোচনার এক পর্যায়ে হামেদ যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তীব্র সমালোচনা করেন। তিনি জানান, হামাস মার্কিন প্রস্তাব শুনতে রাজি হয়েছিল যুদ্ধ অবসানের সম্ভাবনা যাচাই করতে, কিন্তু অভিজ্ঞতা হয়েছে তিক্ত।
“আমেরিকান মধ্যস্থতাকারীর সাথে আমাদের অভিজ্ঞতা ছিল হতাশাজনক। তাদের কোনো বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। তারা নিজেদের প্রস্তাব থেকেও সরে এসেছে,” বলেন হামেদ।
এ বক্তব্য প্রমাণ করে, হামাসের দৃষ্টিতে যুক্তরাষ্ট্র নিরপেক্ষ নয় বরং ইসরাইলের স্বার্থই রক্ষা করে যাচ্ছে।
গাজায় আটক ইসরাইলি বন্দিদের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে হামেদ স্পষ্ট করেন, বন্দিদের সঙ্গে আচরণ হয়েছে সংগঠনের অভ্যন্তরীণ মূল্যবোধ অনুযায়ী।
তার ভাষায়, “আমাদের জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা চললেও আমরা বন্দিদের প্রতি আমাদের নীতির বাইরে যাইনি। যারা তাদের ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে, তারাই দখলদার। আমাদের হাতে বন্দিরা সবসময় আমাদের মূল্যবোধ অনুযায়ী আচরণ পেয়েছে।”
এ বক্তব্যের মাধ্যমে হামেদ আন্তর্জাতিক মহলে হামাসের অবস্থান পরিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন, বিশেষ করে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ থেকে সংগঠনকে দূরে রাখার প্রচেষ্টা স্পষ্ট।
এটি প্রথম নয়, এর আগে আগস্টের শুরুতে আল জাজিরাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারেও গাজী হামেদ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে ৭ অক্টোবরের হামলা ফিলিস্তিনি প্রশ্নকে আবারও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ফিরিয়ে এনেছে। তখন তিনি গর্ব করে বলেন, “আমাদের অস্ত্র ছাড়া কেউ আমাদের দিকে তাকাত না। হামাসের প্রতিরোধ ছাড়া ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রের প্রসঙ্গ বিশ্বমঞ্চে ফেরত আসত না।”
তিনি ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উদাসীনতাকেও কড়া ভাষায় আক্রমণ করেছিলেন।
দোহায় হামলার ঘটনার পর কাতার তীব্র নিন্দা জানায় এবং ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুকে দায়ী করে কঠোর শাস্তির দাবি তোলে। কাতারের আমির দ্রুত জর্ডান সফরে যান এবং ফিলিস্তিন প্রসঙ্গে নতুন আঞ্চলিক আলোচনার ইঙ্গিত দেন। আরব বিশ্বে অনেকেই মনে করছে, এই হামলা ছিল কেবল হামাসকে খতম করার চেষ্টা নয়, বরং মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতিতে কাতারের প্রভাব খর্ব করার প্রচেষ্টা।
অন্যদিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম, বিশেষ করে ইসরাইলি পত্রিকা দ্য জেরুজালেম পোস্ট, উল্লেখ করেছে—দোহা হামলার মাধ্যমে ইসরাইল দেখাতে চেয়েছে যে, ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ যেখানেই থাকুক না কেন, তারা নিরাপদ নয়।
দোহা হামলা কেবল প্রাণঘাতী আক্রমণ নয়; এটি মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক বাস্তবতাকে আরও জটিল করে তুলেছে। গাজী হামেদের সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে—হামাস এখনও সমঝোতার জন্য সম্পূর্ণ অস্বীকৃত নয়, তবে যুক্তরাষ্ট্রকে আর বিশ্বাস করছে না। একইসঙ্গে তারা মনে করছে, আরব দেশগুলোর শক্ত প্রতিক্রিয়াই ইসরাইলের সম্প্রসারণবাদী পরিকল্পনা রুখতে পারে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ