
ছবি: সংগৃহীত
জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে গাজায় যুদ্ধবিরতি নিয়ে উত্থাপিত নতুন প্রস্তাবের বিপক্ষে আবারও ভেটো দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। বৃহস্পতিবার (১৮ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত বৈঠকে যুদ্ধবিরতির এই খসড়া প্রস্তাবে পরিষদের ১৫ সদস্য দেশের মধ্যে ১৪টি দেশ সমর্থন জানালেও একমাত্র বিরোধী ভোটটি আসে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে। এর মধ্য দিয়ে গত দুই বছরে গাজা যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবে ষষ্ঠবারের মতো ভেটো দিল যুক্তরাষ্ট্র। আন্তর্জাতিক মহলে এই অবস্থানকে ‘মানবতার পরাজয়’ বলে আখ্যা দিয়েছে আলজেরিয়া, যারা প্রস্তাবটির অন্যতম প্রধান সমর্থক ছিল।
রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, সর্বশেষ খসড়া প্রস্তাবে গাজায় অবিলম্বে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ঘোষণা, ক্ষতিগ্রস্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য মানবিক সহায়তা প্রবেশের সুযোগ সৃষ্টি এবং ইসরাইলি বন্দিদশায় থাকা জিম্মিদের মুক্তির দাবি জানানো হয়। প্রস্তাবের পক্ষে চীন, রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাজ্যসহ প্রায় সব সদস্য দেশ ভোট দেয়। তবে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি যুক্তি দেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে স্থায়ী যুদ্ধবিরতি ইসরাইলের নিরাপত্তা স্বার্থকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং হামাসকে শক্তিশালী করবে।”
অন্যদিকে অধিকাংশ দেশ যুক্তরাষ্ট্রের এই অবস্থানকে অমানবিক এবং একতরফা বলে মনে করছে। আলজেরিয়ার প্রতিনিধি বলেন, “প্রতিবারই যখন মানবতা রক্ষার আহ্বান জানানো হয়, তখনই ওয়াশিংটনের ভেটো তা ঠেকিয়ে দেয়। এটি শুধু গাজার জনগণের জন্য নয়, আন্তর্জাতিক ন্যায়ের জন্যও এক বড় পরাজয়।”
২০২৩ সালের শেষ দিক থেকে শুরু হওয়া ইসরাইল-হামাস সংঘাতের প্রায় দুই বছর হতে চলেছে। এই সময়ের মধ্যে গাজার প্রায় প্রতিটি অঞ্চলেই ধ্বংসযজ্ঞ নেমে এসেছে। হাজার হাজার বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছেন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। খাদ্য, পানি ও ওষুধের তীব্র সংকটের কারণে মানবিক বিপর্যয় দিন দিন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা বারবার যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানালেও নিরাপত্তা পরিষদে যুক্তরাষ্ট্রের ভেটো এই প্রচেষ্টাকে বারবার ভেস্তে দিয়েছে।
ভেটো প্রদানের দিন ভোর থেকেই গাজা উপত্যকায় নতুন করে শুরু হয় ইসরাইলি বাহিনীর বিমান ও স্থল অভিযান। স্থানীয় সূত্র জানায়, কেবল ওইদিনেই অর্ধশতাধিক ফিলিস্তিনি নিহত হন, যাদের অধিকাংশ গাজা সিটির সাধারণ বাসিন্দা। ভেঙে পড়েছে আবাসিক ভবন, ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছে বহু মানুষ। টানা হামলার কারণে গাজার বহু হাসপাতাল ও আশ্রয়কেন্দ্রও এখন কার্যত অচল হয়ে পড়েছে।
দক্ষিণ গাজার রাফাহ এলাকায় সামরিক অভিযানের সময় বিস্ফোরণে প্রাণ হারিয়েছেন ইসরাইলি সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা ও তিন সেনা। ইসরাইলি বাহিনী জানিয়েছে, অভিযান চালানোর সময় এই বিস্ফোরণ ঘটে। এরপরও রাফাহ অঞ্চলে তল্লাশি ও সামরিক অভিযান অব্যাহত রাখা হয়েছে।
একইদিনে ইসরাইল লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলে হিজবুল্লাহর ঘাঁটি লক্ষ্য করে একাধিক বিমান হামলা চালায়। আক্রমণের আগে স্থানীয় পাঁচটি গ্রাম খালি করার নির্দেশ দেয় ইসরাইলি সেনাবাহিনী। তেল আবিবের দাবি, হিজবুল্লাহ সীমান্ত থেকে ইসরাইলে গোলাবর্ষণ করছিল, তাই আত্মরক্ষার অংশ হিসেবে এই হামলা চালানো হয়েছে।
লেবাননের প্রধানমন্ত্রী এই হামলার তীব্র নিন্দা জানিয়ে বলেন, “ইসরাইলের এ ধরনের আগ্রাসন কেবল আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা বাড়াবে।” হিজবুল্লাহপন্থি আইনপ্রণেতারা অভিযোগ করেছেন, “কূটনীতি বা আন্তর্জাতিক নিশ্চয়তার কোনো মূল্যই ইসরাইল দেয় না।” স্থানীয়রা জানাচ্ছেন, ধ্বংসস্তূপের মধ্যেও তাঁরা প্রতিরোধ চালিয়ে যাবেন।
গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের প্রতিবাদে ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরাও নতুন করে হামলা চালিয়েছে ইসরাইলের দিকে। আকাশে ক্ষেপণাস্ত্র শনাক্ত হওয়ার পর জেরুজালেম ও তেল আবিবে সতর্ক সাইরেন বাজানো হয়। একটি ড্রোন গিয়ে পড়ে দক্ষিণ ইসরাইলের ইলাত শহরে। এ ঘটনায় হতাহতের খবর না মিললেও স্থানীয়দের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং একটি হোটেল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হুতিরা জানিয়েছে, “এই হামলা গাজার মানুষের প্রতি সংহতি জানাতেই চালানো হয়েছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের এ ধারাবাহিক ভেটো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তীব্র সমালোচনার জন্ম দিয়েছে। মানবাধিকার সংস্থাগুলো বলছে, গাজায় নিরপরাধ মানুষ প্রতিদিন নিহত হলেও বিশ্বশক্তির একতরফা অবস্থানের কারণে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেওয়া যাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এভাবে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে নতুন এক বৃহত্তর সংঘাত শুরু হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ