
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’। এই সনদে অন্তর্ভুক্ত সংস্কারমূলক সিদ্ধান্তগুলো বাস্তবায়ন এবং এর আইনি ভিত্তি নিশ্চিত করতে সংবিধান আদেশ ও গণভোটের প্রস্তাব করেছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, আগামী ফেব্রুয়ারিতে যেদিন জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, সেদিনই গণভোট আয়োজনের মাধ্যমে সনদের বিষয়ে জনগণের চূড়ান্ত অনুমোদন নেওয়া হবে। তবে এই গণভোটের সময়সূচি নিয়ে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং মতপার্থক্য তৈরি হয়েছে।
বিএনপি বলছে, জাতীয় নির্বাচনের আগে গণভোট আয়োজন সম্ভব নয়; এটি নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে হওয়া উচিত। তবে যদি সব রাজনৈতিক দল একমত হয়, তাহলে নির্বাচন ও গণভোট একই দিনে আয়োজন করা যেতে পারে। বিএনপি নেতারা মনে করছেন, নির্বাচনের আগেই গণভোট আয়োজন করলে তা জটিলতা তৈরি করবে, কারণ সংস্কার এবং জনগণের মতামত যাচাই দুটো বিষয় আলাদা।
অন্যদিকে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী দৃঢ়ভাবে বলছে, নির্বাচনের আগেই গণভোট করতে হবে এবং সেই গণভোটের ফলাফলের ভিত্তিতেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। জামায়াত ইতোমধ্যেই এই দাবিকে কেন্দ্র করে রাজপথে আন্দোলন শুরু করেছে।
আর জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) বলছে, কেবল গণভোট নয়, বরং সংবিধান ইস্যুতে আলাদা গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন। তাদের মতে, একটি নতুন গণপরিষদ গঠন করেই জনগণের মতামতের ভিত্তিতে নতুন সংবিধান তৈরি করা উচিত। এনসিপি গণভোট প্রসঙ্গে নিজেদের চূড়ান্ত অবস্থান জানাতে আরও আলোচনা করার প্রয়োজনীয়তা দেখছে।
রাজনৈতিক দলগুলোর এই মতভিন্নতার মাঝেও আশাবাদী জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বৃহস্পতিবার বলেছেন— “জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ও আইনি ভিত্তি ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে আমরা অনেক দূর এগিয়েছি। আমি আশাবাদী দ্রুতই এ ব্যাপারে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান পাওয়া যাবে। বিষয়টি কঠিন, তবে অসম্ভব নয়।”
কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সরকারকে একটি সংবিধান আদেশ জারি করার সুপারিশ করা হবে। এর মাধ্যমে সনদের সংস্কারমূলক ধারাগুলো বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। তবে এই সংবিধান আদেশের বৈধতা এবং জনসমর্থন নিশ্চিত করতে গণভোটের আয়োজন অপরিহার্য।
বুধবার ৩০টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কমিশনের বৈঠকের পর বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ সাংবাদিকদের বলেন, “সাংবিধানিক আদেশ আজ বা কাল আদালতে চ্যালেঞ্জ হতে পারে। জাতির সামনে খারাপ উদাহরণ তৈরি করা উচিত নয়। নির্বাচনের দিন গণভোট আয়োজন প্রসঙ্গে আমরা বলেছি, যদি সবাই একমত হয় বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হবেন বলেই আমরা মনে করি আলাদা সংসদীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই সংস্কার হওয়া উচিত।”
তার মতে, মৌলিক কিছু সংস্কার এমনও আছে যেখানে সংসদীয় প্রক্রিয়ার বাইরে আলাদা গণভোটের প্রয়োজন হতে পারে। সেক্ষেত্রে একই বিষয়ে একাধিকবার গণভোট আয়োজন জনগণকে বিভ্রান্ত করবে।
জামায়াতে ইসলামী ভিন্ন অবস্থান নিয়েছে। দলের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ বলেন— “রাষ্ট্রপতির সাংবিধানিক আদেশের মাধ্যমে জুলাই সনদ বাস্তবায়ন হবে, এরপর সে বিষয়ে গণভোট হবে। আমাদের অবস্থান হলো, জাতীয় নির্বাচনের আগেই গণভোট দিতে হবে। এতে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হবে এবং নির্বাচনের আগে সংস্কার নিশ্চিত করা যাবে।”
তিনি আরও বলেন, “রাজনৈতিক দলগুলো যদি ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারে, তাহলে সিদ্ধান্ত জনগণের হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। গণভোটের মাধ্যমে জনগণই নির্ধারণ করবে কোন সংস্কার গ্রহণযোগ্য এবং কোনটি নয়।”
জুলাই সনদে মোট ৮৪টি ধারা বা সিদ্ধান্ত অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এর মধ্যে কিছু ধারার বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো ভিন্নমত (নোট অব ডিসেন্ট) দিয়েছে।
সনদ বাস্তবায়নের তিনটি পথ নির্ধারণ করা হয়েছে—
১. নির্বাহী আদেশ জারি করে কিছু সিদ্ধান্ত কার্যকর করা যাবে।
২. অধ্যাদেশের মাধ্যমে কিছু ধারা বাস্তবায়ন সম্ভব।
৩. প্রায় ৩৪টি ধারা বাস্তবায়নে সংবিধান সংশোধন অপরিহার্য।
প্রথম দুটি ক্ষেত্রে সব রাজনৈতিক দল একমত হলেও সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজনীয় ধারাগুলো নিয়ে দ্বন্দ্ব রয়েছে। বিশেষত গণভোটের মাধ্যমে জনগণের অনুমোদন নেওয়া হবে কি না এবং হলে কবে হবে, এই প্রশ্নেই মতভেদ প্রকট।
ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক শেষে এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক জাবেদ রাসিন বলেন, “আমরা জুলাই সনদ বাস্তবায়নের জন্য সংবিধান আদেশকে যথেষ্ট মনে করি না। আমরা গণপরিষদ নির্বাচন চাই। সেই নির্বাচিত পরিষদই নতুন সংবিধান তৈরি করবে।”
অন্যদিকে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান সরকারের ভূমিকার সমালোচনা করে বলেন, “সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নতুন করে বিভাজন তৈরি করছে। তারা নিজেরা সিদ্ধান্ত নিতে না পেরে বল দলগুলোর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। এতে দায় এড়ানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।”
তিনি আরও প্রশ্ন তোলেন— “যদি জনগণ গণভোটে এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে কী হবে? বিকল্প পরিকল্পনা কী আছে?”
অধ্যাপক আলী রীয়াজ মনে করেন, ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক অবস্থান থাকা স্বাভাবিক। কমিশনের কাজ হলো সেই অবস্থানগুলোকে আলোচনার টেবিলে এনে একটি মধ্যপথ বের করা। তিনি বলেন— “শুরুতে এটি অসম্ভব মনে হলেও এখন অনেক দূর এগিয়েছি। আমরা সরকারের কাছে একাধিক বিকল্প সুপারিশ দেব। যাতে সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ হয়।”
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গণভোট একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হলেও বিরল ঘটনা। সর্বশেষ গণভোট হয়েছিল সামরিক শাসনের সময়। তাই নির্বাচন-পূর্ব প্রস্তাবিত এই গণভোট শুধু আইনি বৈধতার প্রশ্নই তুলছে না, বরং রাজনৈতিক উত্তেজনাও তৈরি করছে। বিএনপি ও জামায়াতের ভিন্ন অবস্থান বিষয়টিকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে কমিশন আশাবাদী, আলোচনার মাধ্যমে একটি সমঝোতায় পৌঁছানো সম্ভব হবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ