
ছবি: সংগৃহীত
হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে চলা দ্বন্দ্ব-সংঘাতের অবসান ঘটাতে অবশেষে বড় ধরনের পদক্ষেপ নিল প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর। দেশের প্রধান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি, যেখানে প্রতিদিন হাজার হাজার দেশি-বিদেশি যাত্রী আসা-যাওয়া করেন, সেখানে নিরাপত্তা কার্যক্রমকে শক্তিশালী ও সমন্বিত করতে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন) আবারও ভেতরের দায়িত্বে ফিরছে। একইসঙ্গে বিমানবাহিনীর সদস্যরা, যাঁরা গত এক বছর ধরে অস্থায়ীভাবে এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন, ধাপে ধাপে নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরে যাবেন।
২০২৪ সালের আগস্টে ঘটে যাওয়া ‘আনসার বিদ্রোহ’কে কেন্দ্র করেই এ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত। সেদিন রাতারাতি হাজারের বেশি আনসার সদস্য বিমানবন্দরের দায়িত্ব ছেড়ে চলে যান। হঠাৎ সৃষ্ট সেই নিরাপত্তা সংকটে বিমানবাহিনীর সদস্যদের অস্থায়ীভাবে বিমানবন্দরের নিরাপত্তায় মোতায়েন করা হয়। একই সময়ে এপিবিএনকে টার্মিনালের ভেতরে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়।
এর পর থেকেই এপিবিএন ও বিমানবাহিনী-নির্ভর অ্যাভিয়েশন সিকিউরিটি (অ্যাভসেক)-এর মধ্যে রেষারেষি শুরু হয়। এপিবিএনের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, তাদের এয়ার সাইডে থাকা অফিসকক্ষ থেকে মালামাল সরিয়ে দিয়েছে অ্যাভসেক। এ নিয়ে থানায় সাধারণ ডায়েরিও হয়। অন্যদিকে যাত্রী হয়রানি, যাত্রীদের ভিডিও চিত্র গণমাধ্যমে ফাঁস করে দেওয়া—এমন অভিযোগও উভয় পক্ষের মধ্যে পাল্টাপাল্টি উঠতে থাকে। বিষয়টি আরও জটিল হয় যখন বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিরাপত্তা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত সদস্য এয়ার কমোডর আসিফ ইকবাল আনুষ্ঠানিক চিঠি দিয়ে এপিবিএন অধিনায়কের বিরুদ্ধে শিষ্টাচার ভঙ্গের অভিযোগ তোলেন।
এই দীর্ঘ টানাপোড়েনের সমাধান টানতেই গত বুধবার প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয় এক উচ্চপর্যায়ের বৈঠক। বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ সহকারী লুৎফে সিদ্দিকী। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের সচিব এম সাইফুল্লাহ পান্না, বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়ের সচিব নাসরীন জাহান, বেবিচক চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মোস্তফা মাহমুদ সিদ্দিক, বেবিচকের নিরাপত্তা বিষয়ক সদস্য এয়ার কমোডর আসিফ ইকবালসহ বেশ কয়েকজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, “সরকারি সংস্থাগুলো একই লক্ষ্যে কাজ করছে। আমাদের কথায় ও কাজে পেশাদারিত্ব বজায় রাখতে হবে এবং পারস্পরিক সম্মান নিশ্চিত করতে হবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বিমানবন্দরের মতো একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যেকোনো ধরনের দ্বন্দ্ব শুধু সংশ্লিষ্ট সংস্থার জন্য নয়, বরং দেশের ভাবমূর্তির জন্যও বড় ক্ষতির কারণ হতে পারে।
বৈঠকে মোট ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, যা বিমানবন্দরের নিরাপত্তা কাঠামোকে নতুনভাবে সাজাতে বড় ভূমিকা রাখবে—
একক কমান্ড, রেগুলেশন ও নিয়ন্ত্রণ: বিমানবন্দরে কার্যকর সব সংস্থা এখন থেকে বেবিচকের একক কর্তৃত্বে কাজ করবে। এতে দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ বা দায়িত্বের বিভ্রান্তি দূর হবে।
এপিবিএনের প্রত্যাবর্তন: খুব শিগগিরই এপিবিএন আবারও বিমানবন্দরের টার্মিনাল ভবনের ভেতরে নিরাপত্তার দায়িত্ব নেবে।
অপারেশনাল চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা: পুলিশের আইজিপি ও বেবিচক চেয়ারম্যান নিয়মিত বৈঠক করে অপারেশনাল সমস্যা সমাধানে কাজ করবেন।
বিমানবাহিনীর টাস্কফোর্স প্রত্যাহার: বিমানবাহিনীর অস্থায়ী টাস্কফোর্স তাদের দায়িত্ব শেষ করলেই নিজ নিজ বাহিনীতে ফিরে যাবে।
সাপ্তাহিক নিরাপত্তা সভা: সব বিমানবন্দরে প্রতি সপ্তাহে অন্তত একটি নিরাপত্তা সভা অনুষ্ঠিত হবে, যাতে সমস্যা চিহ্নিত ও সমাধানের পথ খোঁজা যায়।
পুনর্গঠন ও সংস্কার: দীর্ঘমেয়াদে বেবিচককে আলাদা অপারেটর ও রেগুলেটর হিসেবে পুনর্গঠনের বিষয়ে বেসামরিক বিমান চলাচল মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ জানানো হবে।
শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দেশের প্রবেশদ্বার। প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী এখানে আসা-যাওয়া করেন, আর তাঁদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা রাষ্ট্রের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব। গত এক বছরের দ্বন্দ্ব-সংঘাত যাত্রীদের আতঙ্কিত করেছে এবং আন্তর্জাতিক মহলেও বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এপিবিএনের পুনঃঅংশগ্রহণ এবং একক কমান্ড নিশ্চিত হলে যাত্রীদের আস্থা ফিরবে এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থাও আরও শক্তিশালী হবে।
বিমানবন্দরের নিরাপত্তা শুধু অস্ত্রধারী সদস্যদের দায়িত্ব নয়; এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রযুক্তি, সমন্বয়, দক্ষতা এবং সর্বোপরি পেশাদারিত্ব। বৈঠকে আলোচিত প্রস্তাবিত কাঠামোগত পরিবর্তন যদি বাস্তবায়ন হয়, তবে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল খাতে একটি নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বাংলাবার্তা/এসজে