
ছবি: সংগৃহীত
কাশ্মীরের পেহেলগাঁওয়ে সম্প্রতি পাকিস্তান-সমর্থিত জঙ্গি হামলায় ভারতের ৭ সেনা নিহত হওয়ার ঘটনায় ফের জ্বলছে ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত। ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছে, এই হামলার পাল্টা জবাব দিতে গিয়ে তারা পাকিস্তানের আজাদ কাশ্মীর অংশে ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ পরিচালনা করেছে। পাকিস্তান পক্ষ অবশ্য একে “মিথ্যা দাবি” বলে উড়িয়ে দিয়েছে এবং পাল্টা হামলার প্রস্তুতি নিচ্ছে বলেও বার্তা দিয়েছে।
এরপর থেকেই দুই দেশের সীমান্তে গুলি বিনিময়, যুদ্ধবিমান জড়ো করা, সিন্ধু পানি চুক্তি স্থগিত এবং স্থল ও বায়ু যোগাযোগ বন্ধ—এই প্রতিটি পদক্ষেপই যুদ্ধের সম্ভাবনাকে জোরদার করছে।
এই যুদ্ধ যদি সত্যিই শুরু হয়, তাহলে তা শুধু ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না—এর অভিঘাত পড়বে গোটা দক্ষিণ এশিয়ায়। বিশেষ করে বাংলাদেশ, যেটি ভৌগোলিকভাবে দুই দেশের মধ্যবর্তী এলাকায় অবস্থান করছে, এমন এক সময়ে এই উত্তেজনার মুখোমুখি যখন দেশের অর্থনীতি, কূটনীতি ও নিরাপত্তা সংকটময়।
অর্থনৈতিক অভিঘাত: খাদ্য, পণ্য ও পণ্য পরিবহনে বড় আঘাতের আশঙ্কা
বাংলাদেশ প্রতিবছর ভারতে প্রায় ১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বাণিজ্য করে, যার সিংহভাগই আমদানিনির্ভর। বিশেষ করে পেঁয়াজ, চাল, গম, তুলা, সুতা, কাঁচামাল ও শিল্প সরঞ্জামের বড় অংশ ভারতে থেকে আসে। যুদ্ধ শুরু হলে এই আমদানি চেইন সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ার শঙ্কা আছে।
অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফা কে. মুজেরী বলেন, “আমাদের আমদানির বহুমুখীকরণ এখনো যথেষ্ট নয়। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়ার লজিস্টিকস পুরোপুরি ভেঙে পড়বে। সড়ক, রেল, সমুদ্রপথ—সব বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশ সরাসরি খাদ্য ও শিল্পপণ্যের সংকটে পড়বে।”
বিশ্বব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, “মূল্যস্ফীতির চাপ এমনিতেই আছে। যুদ্ধ হলে আমদানি ব্যাহত হয়ে তা আরও বেড়ে যাবে। বিশেষ করে যারা তুলা, সুতা, কাপড় বা খাদ্যপণ্য আমদানির ওপর নির্ভরশীল—তারা ভয়াবহ বিপদে পড়বে। সরকারকে এখনই বিকল্প উৎস নির্ধারণ করতে হবে।”
পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. আবু ইউসুফ বলেন, “যুদ্ধ হলে শুধু দ্রব্যমূল্য নয়, উৎপাদনেও প্রভাব পড়বে। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও পরিবহন খাতেও বড় আঘাত আসবে। এতে দেশের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রা অর্জন কঠিন হয়ে পড়বে।”
কূটনৈতিক অস্থিরতা: বাংলাদেশ কোথায় দাঁড়াবে?
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ভারত-নির্ভর পররাষ্ট্রনীতিতে চলছে, যেখানে পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে অনুজ্জ্বল। তবে যুদ্ধ পরিস্থিতিতে এই অবস্থানই ঝুঁকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, “আমাদের কূটনৈতিক অবস্থান দুর্বল। যুদ্ধ হলে আমরা কী করব—ভারতের পাশে দাঁড়াব, না নিরপেক্ষ থাকব? এ প্রশ্নের উত্তর এখনো নেই। বাস্তবতা হচ্ছে, দুই দেশের একটির সঙ্গে একচেটিয়া সম্পর্ক গড়ে তোলা আমাদের কৌশলগত দুর্বলতা সৃষ্টি করেছে।”
সাবেক পররাষ্ট্র সচিব ফারুক সোবহান বলেন, “বাংলাদেশের উচিত হবে ‘প্রিন্সিপলড নিউট্রালিটি’—অর্থাৎ নিরপেক্ষ অবস্থান রক্ষা করা, কিন্তু মানবিক ও আঞ্চলিক শান্তির স্বার্থে সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করা।”
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাশেদুজ্জামান বলেন, “আমাদের কূটনীতি যদি শুধুই 'চুপ করে থাকা' হয়, তাহলে আমরা দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃস্থানীয় ভূমিকায় কখনো যেতে পারব না। ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষে একজন শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে বাংলাদেশকে এখনই এগোতে হবে।”
শিল্প-বাণিজ্যে চেইন রিঅ্যাকশন: শিল্প বন্ধ, কর্মসংস্থান হুমকিতে
বাংলাদেশের পোশাক, কাগজ, পাট, ওষুধ শিল্প অনেকাংশে ভারতের কাঁচামালের ওপর নির্ভরশীল। যুদ্ধ শুরু হলে এই খাতগুলোতে উৎপাদন থেমে যেতে পারে। এতে হাজার হাজার শ্রমিক চাকরি হারাতে পারেন।
বিজিএমইএ পরিচালক মঞ্জুরুল হক বলেন, “আমাদের ফ্যাব্রিকের ৪৫% এর বেশি ভারতে থেকে আসে। বিশেষ করে ট্রানজিট, ট্রাক, কাস্টমস পয়েন্ট বন্ধ হয়ে গেলে উৎপাদন বন্ধ হয়ে যাবে। এতে অর্ডার বাতিল হবে, শ্রমিক ছাঁটাই হতে পারে।”
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, “আঞ্চলিক সংঘর্ষ হলে বাণিজ্যিক বীমা খরচ বেড়ে যাবে, শিপমেন্ট বিলম্বিত হবে, এলসি খোলা কঠিন হবে। এসবের প্রভাব সরাসরি রপ্তানিতে পড়বে।”
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তা: সীমান্তে সতর্কতা ও রোহিঙ্গা সংকট
মিয়ানমারের সঙ্গে আগে থেকেই বাংলাদেশের উত্তেজনা বিরাজ করছে। এখন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হলে বাংলাদেশ একযোগে দুটি ফ্রন্টে চাপে পড়বে—পূর্ব সীমান্তে মিয়ানমার, পশ্চিমে ভারতের সীমান্ত অনিশ্চয়তা।
সাবেক সেনা কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শামিম কামাল বলেন, “ভারত যদি যুদ্ধ পরিস্থিতিতে পড়ে, তাহলে তারা সীমান্ত নিরাপত্তা আরও কড়া করবে। এতে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেও চাপ পড়বে। আবার রোহিঙ্গা সংকটের দিকেও নজর দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে।”
রব মজুমদার, নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ ও সিকিউরিটি ওয়ার্ল্ড ম্যাগাজিনের সম্পাদক বলেন, “দুই পারমাণবিক শক্তিধর দেশের সংঘর্ষ মানে শুধু সামরিক নয়—সাইবার যুদ্ধ, জ্বালানি যুদ্ধ, আর্থিক নিষেধাজ্ঞার মতো অদৃশ্য যুদ্ধের সম্ভাবনাও থাকে। এসব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কারণ আমরা প্রস্তুত না।”
বাংলাদেশ কী করতে পারে? করণীয় ও কৌশলগত প্রস্তুতি
অর্থনৈতিক প্রস্তুতি:
বিকল্প আমদানি উৎস যেমন চীন, মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড থেকে পণ্য আনার পরিকল্পনা।
দেশের খাদ্য ও জ্বালানি মজুদ বাড়ানো।
বন্দর ও শুল্ক বিভাগে জরুরি ট্রানজিট ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলা।
কূটনৈতিক প্রস্তুতি:
জাতিসংঘ, ওআইসি ও সার্ক ফোরামে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ।
ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা রেখে শান্তিপূর্ণ অবস্থান ঘোষণার প্রস্তুতি।
নিরপেক্ষ কূটনৈতিক বার্তা প্রচারে রাষ্ট্রীয় প্রচারণা।
নিরাপত্তা প্রস্তুতি:
সীমান্ত এলাকায় বিজিবি ও সেনাবাহিনীকে সতর্ক অবস্থানে রাখা।
অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা প্রতিরোধে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়ানো।
রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর নিরাপত্তা জোরদার।
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারেই অবাস্তব নয়। দক্ষিণ এশিয়া এক জটিল ভূরাজনৈতিক অঞ্চলে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিটি সংঘর্ষের প্রভাব বহুদূর পর্যন্ত যায়। বাংলাদেশ যদি এখনই বাস্তববাদী পরিকল্পনা গ্রহণ না করে, তাহলে যুদ্ধ শুরু হলে তার অভিঘাত রোধ করার সুযোগ থাকবে না।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ‘‘যুদ্ধ কখনো শুধু দুই পক্ষের থাকে না। এর ছায়া পড়ে আশেপাশের সবার উপর।’’ বাংলাদেশ এখনো সেই ছায়ার নিচে না এলেও তার ঘনত্ব বাড়ছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ