
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা জেনারেটিভ এআইয়ের উদ্ভাবনী ক্ষমতা যেমন বিস্ময় জাগিয়েছে, তেমনি এর অপব্যবহারও দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটকসহ নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিনিয়ত ছড়িয়ে পড়ছে ভুল, অর্ধসত্য, গুজব কিংবা মিথ্যা তথ্যে সাজানো ছবি ও ভিডিও। কখনো নদীতে ঘরবাড়ি ডুবে যাচ্ছে, কখনো ঘটেনি এমন দুর্ঘটনার দৃশ্য চোখে পড়ে। প্রথম দর্শনে এগুলো বাস্তব মনে হলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেগুলো জেনারেটিভ এআইয়ের কল্পনাজনিত সৃষ্টির ফসল। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, এখনই কঠোর নিয়ন্ত্রণ ও সচেতনতা না আনলে এর পরিণতি হবে ভয়াবহ।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ইতিহাসে চাঞ্চল্যকর এক ঘটনা ছিল মাইলস্টোন ট্র্যাজেডি। যেখানে মৃত ব্যক্তির ছবি বা মুখ ব্যবহার করে ‘জীবিত’ দেখানো হচ্ছে তাদের। শুধু তাই নয়, তাদের কণ্ঠ নকল করে এমন বক্তব্যও শোনানো হচ্ছে যা তারা কখনো বলেননি। ঘটনাটি যতটা বাস্তব মনে হয়, বাস্তবে তা নিছকই এআই কারসাজি। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এই ধরনের ভুয়া ভিডিওর সংখ্যা এতটাই বেড়েছে যে সত্য-মিথ্যার বিভাজন করাই এখন সাধারণ মানুষের জন্য চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
‘মানুষ বিশ্বাস করে না’—এই ধারণাটি বাস্তবে যে কতটা ভুল, তা বোঝা যায় এসব ভিডিওর নিচের মন্তব্য পড়লেই। টাইটেল, ভিজ্যুয়াল কোয়ালিটি আর বিশ্বাসযোগ্য বর্ণনায় অনেকে এমনকি চোখের জল ফেলেন ভুয়া ভিডিও দেখে। এভাবেই সমাজে ছড়াচ্ছে তথ্য বিভ্রাট এবং তৈরি হচ্ছে বিভ্রান্তিমূলক ন্যারেটিভ।
গণযোগাযোগ ও মিডিয়া বিশ্লেষক ড. আফতাব হোসেন জানান, “ভুল তথ্য বা অপতথ্য সত্যের চেয়ে ছয়গুণ দ্রুত ছড়ায়।” তার মতে, এই পরিস্থিতি শুধু বিভ্রান্তির জন্ম দিচ্ছে না, বরং মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য, জাতীয় নিরাপত্তা এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়াকেও হুমকির মুখে ফেলছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নাগরিকদের পরিচয় সংক্রান্ত তথ্য যেমন জাতীয় পরিচয়পত্র (NID) কিংবা মোবাইল নাম্বার, ঠিকানা ইত্যাদি যদি এআই মডেলের হাতে পড়ে, তাহলে তা হয়ে উঠবে ভয়ঙ্কর অস্ত্র। এআই এখন কেবল ছবি নয়, বরং মানুষের মুখ, কণ্ঠ, এমনকি চিন্তা-ভাবনার অনুকরণেও সক্ষম। তাই এই প্রযুক্তিকে কতটা তথ্য দেওয়া হবে আর কতটা নয়, সেটি জানার প্রয়োজনীয়তা এখন জরুরি।
এমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে আসন্ন ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এআই ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে। এই পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খোদ প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন। তিনি বলেন, "নির্বাচনে এআইয়ের অপব্যবহার বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।" তিনি বিশেষভাবে সতর্ক করেছেন যে, কোনো একটি মহল রাজনৈতিক বিভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে পারে।
অপরাধ বিশ্লেষক ড. তৌহিদুল হকও একই ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, "স্বার্থান্বেষী মহল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সামাজিক মেরুকরণ এবং মতামত প্রভাবিত করার চেষ্টা করে। এটি একটি সূক্ষ্ম মানসিক যুদ্ধ।"
তার মতে, এই ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে আরও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে এসব গোষ্ঠিকে চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রযুক্তি বিশ্লেষক তানভীর হাজান জোহা বলেন, “আপনি যেকোনো তথ্য আজকের দিনে শেয়ার করলেই সেটি কেউ না কেউ ভবিষ্যতে ব্যবহার করে ফেলবে—এটাই এখন বাস্তবতা।” তিনি জানান, দেশের সাইবার নিরাপত্তা আইনে এআই সংক্রান্ত রেগুলেশন খসড়া অবস্থায় আছে, তবে তা দ্রুত চূড়ান্ত করে প্রয়োগ জরুরি।
তার মতে, এআই শুধু ভালো উদ্দেশ্যে নয়, বরং খারাপ উদ্দেশ্যেও ব্যবহার করা সম্ভব। তাই এই প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ না করে ছেড়ে দিলে দেশের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামো হুমকির মুখে পড়বে।
এই সংকট শুধু বাংলাদেশের একার নয়। গুগল সম্প্রতি জানিয়েছে, তারা দ্বিতীয় প্রান্তিকে চীন ও রাশিয়ার সমর্থনে পরিচালিত ১১ হাজার ইউটিউব চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। এই চ্যানেলগুলোতে রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা, ধর্মীয় উসকানি এবং ভুল তথ্য ছড়ানোর অভিযোগ ছিল। শুধু চীন থেকেই ৭ হাজার ৭০০টি চ্যানেল সরানো হয়েছে। রাশিয়ার চ্যানেলগুলো ইউক্রেন যুদ্ধ ও পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাত। এমনকি ইরান, তুরস্ক, আজারবাইজান, ঘানা, ইসরাইলের পক্ষেও নানা বিভ্রান্তিকর ভিডিও প্রকাশ করা হতো।
টিকটকও বাংলাদেশ থেকে ১ কোটি ১০ লাখ ভিডিও সরিয়েছে—যার অধিকাংশই ছিল বিভ্রান্তিকর, আপত্তিকর কিংবা নিরাপত্তা ঝুঁকিপূর্ণ।
এআই এখন বাস্তবতা। এর ক্ষমতা ও সামর্থ্য অস্বীকার করার সুযোগ নেই। কিন্তু এই প্রযুক্তির ব্যবহারে নিয়ন্ত্রণ না আনলে যে তা বড় ধরনের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংকটে রূপ নিতে পারে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। প্রযুক্তির সুফল পেতে হলে এর অপব্যবহার রোধে এখনই উপযুক্ত নীতিমালা, কঠোর বাস্তবায়ন এবং জনসচেতনতা বাড়ানো ছাড়া কোনো বিকল্প নেই।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এখনই সময় যৌক্তিক গবেষণা ও নীতিমালার ভিত্তিতে এআইকে নিয়ন্ত্রিত পথে পরিচালিত করার। না হলে ভবিষ্যতে এআই হবে না প্রযুক্তির আশীর্বাদ, হয়ে উঠবে এক ভয়ানক অভিশাপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ