
ছবি: সংগৃহীত
জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে প্রতিবছর বিশ্ব অর্থনীতিতে গড়ে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার ক্ষতি হচ্ছে—এই বিপর্যয় সামনে রেখে সাভারে অনুষ্ঠিত হলো ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম (FIF) ২০২৫-এর অষ্টম আসর। “কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও জীবিকায় জলবায়ু অভিযোজন” প্রতিপাদ্যে আয়োজিত এ সম্মেলনে স্থানীয় বাস্তবতা ও গ্লোবাল সাউথ-এর উদ্ভাবনী চর্চার আলোকে জলবায়ু অভিযোজনের টেকসই পথরেখা নির্ধারণের প্রয়াস চালানো হয়।
ব্র্যাকের আয়োজনে ২৫ ও ২৬ জুলাই সাভারের ব্র্যাক সিডিএম-এ অনুষ্ঠিত এ সম্মেলনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের দুই শতাধিক বিশেষজ্ঞ, নীতিনির্ধারক, উদ্যোক্তা, গবেষক ও উন্নয়নকর্মী অংশ নেন। উদ্বোধনের শুরুতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে ঘটিত মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় নিহতদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।
ব্র্যাকের নির্বাহী পরিচালক আসিফ সালেহ্ উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, “পৃথিবী যেন অগ্নিগর্ভে পরিণত হয়েছে। প্রতি বছর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতে গড়ে ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বিশ্বের এই প্রান্তের মানুষজন, যারা এই ক্ষতির ভার বইতে অক্ষম।”
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু অভিযোজন কেবল টিকে থাকার লড়াই নয়, এটি মানুষের মর্যাদা ও জীবিকার সুরক্ষার বিষয়। আলোচনা হওয়া উচিত অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের প্রেক্ষাপটে।
বক্তব্যে আসিফ সালেহ্ বলেন, “বিশ্বে এখনও ৭০০ মিলিয়ন মানুষ দৈনিক মাত্র ২.১৫ ডলারের কম আয়ে জীবনযাপন করছেন। এদের ৯৯ শতাংশ গ্লোবাল সাউথ-এ বাস করেন। পানির স্তর দ্রুত নিচে নামছে—মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল বিশ্বের প্রথম পানিশূন্য আধুনিক শহরে পরিণত হতে পারে। বিশ্ব তাপমাত্রা যদি ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়, তাহলে প্রায় ২০০ কোটি মানুষ চরম তাপদাহের ঝুঁকিতে পড়বেন, যাদের বেশিরভাগই দক্ষিণ গোলার্ধের বাসিন্দা।”
তিনি আরও বলেন, “জলবায়ু সংকট ভবিষ্যতের হুমকি নয়—এটা এখনকার বাস্তবতা। দীর্ঘতর তাপপ্রবাহ, অনিয়মিত বৃষ্টিপাত, বন্যা ও খরার কারণে আগামী ২৫ বছরের মধ্যে খাদ্যব্যবস্থায় ভয়াবহ বিপর্যয়ের আশঙ্কা রয়েছে।”
অনলাইনে যুক্ত হয়ে ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের মহাসচিব ও মালদ্বীপের সাবেক প্রেসিডেন্ট মহামান্য মোহাম্মদ নাশিদ বলেন, “বর্তমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক কাঠামো জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষা করছে না। উন্নয়নশীল দেশগুলো পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ও টেকসই অবকাঠামো নির্মাণে বিনিয়োগ করতে পারছে না, কারণ ঋণ পেতে তাদের অনেক বেশি মূল্য দিতে হচ্ছে। অভিযোজনের জন্য অর্থায়নও প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। উন্নয়নের জন্য স্বল্পসুদে অর্থায়নের সুযোগ জরুরি বৈশ্বিক অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।”
দুই দিনের সম্মেলনে ছিল একাধিক প্যানেল আলোচনার আয়োজন। প্রথম দিনের উল্লেখযোগ্য সেশনের মধ্যে ছিল:
‘ট্রান্সফরমেশনাল অ্যাডাপটেশন ইন এগ্রিকালচার’ — সঞ্চালনায় ছিলেন ব্র্যাক ক্লাইমেট হাব-এর ঊর্ধ্বতন পরিচালক ক্রিস্টিনা চ্যান।
‘নেভিগেটিং আনসার্টেনটি থ্রু ক্লাইমেট ইনফরমেশন সার্ভিসেস’ — ব্র্যাক ইন্টারন্যাশনাল কেনিয়ার ডিজেফু গ্যাটাচো সঞ্চালনায়।
‘ফার্মিং ফর দ্য ফিউচার’ — ব্র্যাকের কুলদীপ বন্ধু আরিয়ালের সঞ্চালনায় ছোট কৃষকদের জন্য উদ্ভাবনী কৌশল।
‘নেচার বেইজড সল্যুশনস’ — অধ্যাপক আনোয়ারুল আবেদীনের নেতৃত্বে আলোচনা।
প্রতিটি অধিবেশনেই আলোচনার কেন্দ্রে ছিল স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জ্ঞান ও উদ্ভাবন—যা অল্প খরচে বড় সমস্যার সমাধান দিতে সক্ষম।
প্রদর্শনীতে উঠে আসে ইনসোরকাউ, আইফার্মার, উইগ্রো, গ্রীন ডেল্টা ইন্স্যুরেন্স-এর মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর উদ্ভাবনী প্রযুক্তি, যা কৃষকদের আবহাওয়া জনিত অনিশ্চয়তা, ফসল উৎপাদন হ্রাস ও ক্ষয়ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করতে সহায়তা করছে।
এছাড়াও জলবায়ু সহনশীল বীজ, ক্লাইমেট স্মার্ট ফাইন্যান্স, কৃষি-ভিত্তিক ডিজিটাল সল্যুশন ইত্যাদি তুলে ধরা হয়।
ফোরামে ব্র্যাকের ‘ফ্রুগাল ইনোভেশন ফেলো’ হিসেবে অংশ নেওয়া এসথার কিমানি (কেনিয়া), ঘিসলেইন ইরাকোজে (রুয়ান্ডা) এবং মুবাসসির তাহমিদ (বাংলাদেশ)-এর উদ্ভাবনগুলো বিশেষভাবে আলোচিত হয়। তারা দেখিয়েছেন কীভাবে সীমিত সম্পদ দিয়েও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী নিজেদের সমস্যা নিজেরাই সমাধান করতে পারে।
শনিবার দ্বিতীয় দিনে বক্তব্য রাখবেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান এবং ফোরামের সমাপ্তি ঘোষণা করবেন ব্র্যাকের চেয়ারপারসন ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।
২০১৩ সালে যাত্রা শুরু করা ফ্রুগাল ইনোভেশন ফোরাম এখন গ্লোবাল সাউথের উদ্ভাবনী সমাধান বিনিময়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। এ বছর জলবায়ু অভিযোজন নিয়ে সম্মেলনের মূল বার্তা হলো— কেবল জনগণের জন্য নয়, তাদের নিয়েই সমাধান গড়ে তুলতে হবে। কারণ প্রতিকূলতার মাঝেও টিকে থাকার পথ খুঁজে নিচ্ছেন তারাই, যাঁরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে আছেন। আর এই সংকট মোকাবিলার উত্তরাধিকার শুরু হয় তাদের হাত ধরেই।
বাংলাবার্তা/এমএইচ