
ছবি: সংগৃহীত
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণঅভ্যুত্থানের সময় দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত সহিংসতা, হত্যাকাণ্ড ও গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত সারাদেশে ১ হাজার ৬০১টি মামলা দায়ের হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে উদ্বেগজনক হলো, পুলিশের গুলিতে সাধারণ মানুষ হতাহত হওয়ার ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধেই দায়ের করা হয়েছে ৭৬১টি মামলা।
এই মামলাগুলোর আসামির তালিকায় রয়েছেন পুলিশের সর্বোচ্চ পদমর্যাদার কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কনস্টেবল পর্যন্ত। মামলার বাদীরা মূলত নিহতদের পরিবার, আহত ব্যক্তি ও প্রত্যক্ষদর্শীরা, যারা পুলিশি বর্বরতার সরাসরি শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেন। মামলাগুলোতে অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন সাতজন সাবেক আইজিপি, ডিআইজি, এসপি থেকে শুরু করে মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তারাও। পুলিশ সদর দপ্তরের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এসব মামলায় আসামি করা হয়েছে ১,১৬৮ জন পুলিশ সদস্যকে।
অত্যন্ত স্পর্শকাতর এসব মামলায় বিচারপ্রক্রিয়া শুরু হলেও তদন্তে গতি নেই বলেই মনে করছেন সংশ্লিষ্ট আইনজীবী ও ভুক্তভোগীরা। কারণ, দেড় হাজারেরও বেশি পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এখন পর্যন্ত গ্রেফতার হয়েছেন মাত্র ৬১ জন। তদন্তকারী কর্মকর্তারা বলছেন, পুলিশ সদস্যরা আসামি হওয়ায় মামলাগুলোর তদন্ত অত্যন্ত সতর্কভাবে করতে হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করতে গিয়ে ভুল হলে বাহিনীর মধ্যে অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এজন্য সময় নিয়ে প্রমাণ ও সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করে সুনির্দিষ্টভাবে মামলা এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
মামলার তালিকা বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সবচেয়ে বেশি ১৭৫টি মামলা হয়েছে ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সাবেক প্রধান হারুন অর রশীদের বিরুদ্ধে। এরপর রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন (১৫৯টি), ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার (১২৯টি), এবং সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান (১১৮টি)।
তালিকায় আরও আছেন সাবেক আইজিপি শহীদুল হক (২৪টি), বেনজীর আহমেদ (১৩টি), হাসান মাহমুদ খন্দকার (৭টি), এবং জাবেদ পাটোয়ারী (২টি)। উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের পাশাপাশি বিপুল সংখ্যক এসপি, এএসপি, পরিদর্শক, উপ-পরিদর্শক ও কনস্টেবলও অভিযুক্ত হয়েছেন।
গ্রেফতার হওয়া পুলিশ সদস্যদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, এ কে এম শহীদুল হক, সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া, যুগ্ম কমিশনার মশিউর রহমান, ডিআইজি মোল্যাহ নজরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম মহানগর পুলিশের সাবেক কমিশনার সাইফুল ইসলাম, ডিএমপির সাবেক উপকমিশনার জসীম উদ্দীন মোল্লা এবং একাধিক এসপি ও এএসপি।
তবে তালিকায় থাকা সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, হাবিবুর রহমান, মনিরুল ইসলামসহ একাধিক প্রভাবশালী কর্মকর্তা এখনো পলাতক, অনেকে দেশও ছেড়েছেন বলে জানা গেছে।
গণঅভ্যুত্থান ও পুলিশের গুলিতে হতাহতের ঘটনায় দায়েরকৃত মামলার মধ্যে দুটি মামলা বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন। এসব মামলায় ৯ জন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন হয়েছে। বিশেষ একটি মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল এবং সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন অভিযুক্ত হয়েছেন।
আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো চাঁনখারপুলে ছাত্র আন্দোলনে অংশ নেওয়া ছয়জন তরুণকে গুলি করে হত্যার মামলা। এতে হাবিবুর রহমানসহ আটজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ গঠন করে আগামী ১০ ও ১১ আগস্ট শুনানির দিন ধার্য করেছে আদালত।
মামলাগুলোর মধ্যে ৬৮টির তদন্ত করছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই), যেখানে ৯৯ পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। ডিএমপির ডিবি বিভাগ তদন্ত করছে আরও ৪৭টি মামলা। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এসব মামলার প্রতিটিকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করা হচ্ছে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নিয়মিত তদারকি করছেন।
তদন্ত চলাকালে কয়েকজন পুলিশ সদস্যকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। এদের মধ্যে আছেন এসআই, এএসপি, ডিএমপির উপকমিশনার পর্যায়ের কর্মকর্তারাও। তবে ভুক্তভোগী পরিবার ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, কেবল সাময়িক বরখাস্ত যথেষ্ট নয়—দ্রুত তদন্ত শেষ করে দোষীদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়াই এখন সময়ের দাবি।
মানবাধিকার সংগঠন, রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, এই মামলাগুলো দ্রুত, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছভাবে নিষ্পত্তি না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি আরও গভীর হবে। তারা বলছেন, গুলির নির্দেশদাতা থেকে শুরু করে যারা সরাসরি গুলি চালিয়েছে, প্রত্যেককে আইনের আওতায় আনা না গেলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রতি জনআস্থা ভেঙে পড়বে।
জুলাই অভ্যুত্থানের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে দেশব্যাপী যে তীব্র আলোচনার সৃষ্টি হয়েছে, তা এই মামলাগুলোর মাধ্যমেই নিরসন হতে পারে। তবে এজন্য প্রয়োজন হবে নিরপেক্ষ, নির্ভরযোগ্য এবং জবাবদিহিমূলক তদন্ত ও বিচার। জনগণ আশা করছে, ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী যথাযথ পদক্ষেপ নেবে এবং দোষীদের ছাড় দেওয়া হবে না।
বাংলাবার্তা/এমএইচ