
ছবি: সংগৃহীত
চোখের দৃষ্টি যেখানে, কমান্ডও সেখানেই—এই ধারণাকে বাস্তবে রূপ দিতে যাচ্ছে প্রযুক্তি জায়ান্ট অ্যাপল। প্রতিষ্ঠানটি তাদের অত্যাধুনিক Vision Pro হেডসেট ব্যবহারকারীদের জন্য একটি নতুন ফিচার পরীক্ষা করছে, যা হাতের কোনো সাহায্য ছাড়াই শুধু চোখের ইশারায় স্ক্রলিং, নেভিগেশন এবং কন্টেন্ট এক্সপ্লোরেশন সম্ভব করবে। এ ফিচার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে VisionOS অপারেটিং সিস্টেমের পরবর্তী সংস্করণে, যার নাম VisionOS 3।
প্রযুক্তি বিষয়ক বিশ্লেষক মার্ক গুরম্যান প্রথম এই তথ্য জানান, যার বরাতে দ্য ভার্জ (The Verge) একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। এতে বলা হয়, অ্যাপলের এই নতুন ফিচারটি ব্যবহারকারীর চোখের গতি ও অবস্থান শনাক্ত করে তৎক্ষণাৎ স্ক্রিনে নির্দিষ্ট অংশে ফোকাস করতে সক্ষম। অর্থাৎ, ব্যবহারকারী চোখের দৃষ্টিতে যেদিকে তাকাবেন, ইন্টারফেস সেই অনুযায়ী প্রতিক্রিয়া দেখাবে।
এই পদ্ধতিতে শুধু স্ক্রল নয়, মেনু থেকে মেনুতে নেভিগেশন, লেখা পড়া, অ্যাপ ব্রাউজিং, এমনকি বেশ কিছু কমান্ড দেওয়া যাবে শুধু চোখের সাহায্যে। প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মতে, এটি একাধারে ইউজার ইন্টারফেসের ভবিষ্যৎ নির্মাণে একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ এবং অ্যাক্সেসিবিলিটির দিক থেকে এক বৈপ্লবিক উদ্ভাবন।
প্রাথমিকভাবে অ্যাপলের এই দৃষ্টি-নির্ভর স্ক্রলিং প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানটির নিজস্ব অ্যাপগুলোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। তবে ভবিষ্যতে এটি উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে অন্যান্য অ্যাপ ডেভেলপারদের জন্যও। অ্যাপল ইতোমধ্যে এমন ডেভেলপার টুলস প্রস্তুত করছে, যা ব্যবহার করে তৃতীয় পক্ষের অ্যাপ ডেভেলপাররা তাদের অ্যাপেও চোখ-নিয়ন্ত্রিত ইন্টারফেসের সংযুক্তি ঘটাতে পারবেন।
এর ফলে, অ্যাপল ইকোসিস্টেমে এমন এক যুগের সূচনা হবে যেখানে হ্যান্ডস-ফ্রি, চোখনির্ভর কমান্ড প্রযুক্তি ধীরে ধীরে স্ট্যান্ডার্ড হয়ে উঠতে পারে।
এই নতুন উদ্ভাবন শুধু প্রযুক্তির দিক থেকে নয়, বরং মানবিক ও সামাজিক বিবেচনাতেও বিশাল সম্ভাবনা তৈরি করছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যারা শারীরিকভাবে অক্ষম, বিশেষত যাদের হাতের ব্যবহার সীমিত বা একেবারেই সম্ভব নয়, তাদের জন্য এ ধরনের হ্যান্ডস-ফ্রি নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি হতে পারে জীবন বদলে দেওয়া একটি সমাধান।
অ্যাপল বরাবরই অ্যাক্সেসিবিলিটি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রযুক্তি উন্নয়নে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে এসেছে। চোখের দৃষ্টি দিয়ে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করার এ প্রচেষ্টা সেই ধারাকেই আরও শক্তিশালী করে তুলছে। এটি প্রযুক্তিকে কেবল স্মার্টই নয়, বরং আরও সহানুভূতিশীল ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তুলছে।
Apple Vision Pro হেডসেটটি মূলত মিশ্র বাস্তবতা (Mixed Reality) বা এক্সটেন্ডেড রিয়েলিটি (XR) অভিজ্ঞতা প্রদানে উদ্ভাবিত এক হাই-এন্ড গ্যাজেট, যার লক্ষ্য বাস্তব ও ভার্চুয়াল জগতে সমন্বিত অভিজ্ঞতা তৈরি করা। এখানে ভয়েস, হাতের ইশারা ও চোখের দৃষ্টি—এই তিন উপাদানের মাধ্যমে পুরো ইন্টারফেস নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এর মধ্যে নতুন করে চোখের ইশারায় স্ক্রলিং সুবিধা যুক্ত হলে এটি আরও বেশি পরিপূর্ণ ও ব্যবহারবান্ধব হয়ে উঠবে।
অ্যাপল VisionOS 3-এ এই নতুন ফিচারকে কেন্দ্র করে এখন থেকেই প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছে। কেউ কেউ এটিকে "ফিউচার অব হিউম্যান-মেশিন ইন্টারঅ্যাকশন" বলেও অভিহিত করছেন।
অ্যাপলের এই নতুন উদ্যোগ ইতিমধ্যেই ভবিষ্যতের ইন্টারফেস ডিজাইন ও কন্ট্রোল পদ্ধতির প্রেক্ষাপট বদলে দিচ্ছে। চোখের দৃষ্টিকে কম্পিউটিং কমান্ডে রূপান্তরের এ প্রয়াস কেবল একটি প্রযুক্তিগত পরীক্ষা নয়, বরং এটি আধুনিক প্রযুক্তির সেই দৃষ্টিভঙ্গিরই প্রতিফলন, যেখানে মেশিন ও মানুষের সংযোগ আরও সাবলীল, প্রাকৃতিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই চোখনির্ভর এই কমান্ডিং সিস্টেম শুধু হেডসেটেই নয়, স্মার্টফোন, ল্যাপটপ ও স্মার্ট হোম ডিভাইসেও ছড়িয়ে পড়বে। এতে করে ব্যবহারকারীরা একটি সম্পূর্ণ নতুন ইন্টারঅ্যাকশন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হবেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, অ্যাপল আবারও প্রমাণ করলো তারা প্রযুক্তির ভবিষ্যৎ নির্মাণে পথপ্রদর্শকের ভূমিকায় রয়েছে। Vision Pro হেডসেটে চোখের ইশারায় স্ক্রল করার নতুন এই ফিচার প্রযুক্তি ও মানবিকতার এক মিলনস্থল তৈরি করছে, যেখানে আধুনিক উদ্ভাবন শুধু সুবিধা নয়, সমতা ও সম্ভাবনার দ্বারও খুলে দিচ্ছে। VisionOS 3–এর মাধ্যমে এই বৈপ্লবিক ফিচার ব্যবহারকারীদের হাতে—or বলা ভালো, চোখে—তুলে দিতে অ্যাপলের এই পদক্ষেপ নিঃসন্দেহে প্রযুক্তি ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ