
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের সরকারি সেবায় তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার দুই দশক আগে এবং এখন একেবারেই আলাদা চিত্র। অতীতের স্মৃতি থেকে শুরু করলে, তখন সরকারি অফিসগুলোতে দীর্ঘ ফাইলের স্তূপ, অসংখ্য কাগজপত্র এবং সময়সাপেক্ষ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে সেবা গ্রহণ করাই ছিল সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ। সরকার ও নাগরিকের মধ্যকার এই প্রথাগত ব্যবস্থায় কাজগুলো প্রায়ই জটিল এবং ধীরগতি সম্পন্ন হতো। তবে গত দুই দশকে তথ্যপ্রযুক্তির বিস্তৃতি ও আধুনিকীকরণের ফলে সরকারি সেবা অনেকাংশে বদলে গিয়েছে, যদিও এখনও অনেক ক্ষেত্রে তার গতি ও গুণগত মান উন্নত করার প্রয়োজন রয়েছে।
তথ্যপ্রযুক্তির এই উন্নয়নের গ্লোবাল প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ কেমন অবস্থানে আছে তা বুঝতে হলে বিশ্বের উন্নত ও উদ্ভাবনী দেশগুলোর উদাহরণ দেখা জরুরি। এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলো কিভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমেই সরকারের সেবাকে নাগরিকের দরজায় পৌঁছে দিয়েছে, সেটাই আমাদের শেখার বিষয়।
এস্তোনিয়া: ডিজিটাল রেভোলিউশনের পথিকৃৎ
১৯৯১ সালে স্বাধীন হওয়া ইউরোপের ক্ষুদ্র দেশ এস্তোনিয়া শুরুর দিকে প্রযুক্তিগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে ছিল। কিন্তু মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দেশটি ডিজিটালাইজেশনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি সাধন করে। ১৯৯৭ সালে অনলাইনে সরকারি সেবা চালু করে এস্তোনিয়া প্রথমবারের মতো সরকারকে নাগরিকের কাছে আরও কাছে নিয়ে আসে। এরপর ২০০২ সালের মধ্যে দেশের সকল স্কুলে ইন্টারনেট চালু করায় প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটে।
সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উদ্ভাবন হিসেবে তারা ‘এক্স-রোড’ নামের একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে, যা সরকারি এবং বেসরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে নিরাপদ তথ্য বিনিময় নিশ্চিত করে। এই প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে নাগরিকরা ঘরে বসে কর প্রদান, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ, ব্যাংকিং কার্যক্রম এবং এমনকি ভোট প্রদানের মতো কাজ করতে সক্ষম হয়। এস্তোনিয়া ছিল প্রথম দেশ যারা ব্লকচেইন প্রযুক্তি সরকারি ব্যবস্থায় প্রয়োগ করে এবং ‘ই-রেসিডেন্সি’ চালু করে, যার মাধ্যমে বিশ্বের যেকোনো ব্যক্তি নাগরিকত্ব ছাড়াই এস্তোনিয়ার ডিজিটাল সেবা ব্যবহার করতে পারেন। এটি ব্যবসা নিবন্ধন, ট্যাক্স ফাইলিং এবং ই-সিগনেচারের মতো সেবা অন্তর্ভুক্ত করে।
সিঙ্গাপুর: উন্নয়নের জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার
অর্থনৈতিক দিক থেকে অনগ্রসর অবস্থান থেকে ১৯৬৫ সালে স্বাধীন হওয়া সিঙ্গাপুর ১৯৮০-এর দশকে প্রযুক্তিকে দেশের উন্নয়নের প্রধান অগ্রণী হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। ১৯৯৯ সালে ‘ইসিটিজেন’ নামে ওয়ানস্টপ পোর্টাল চালু করে, যেখানে নাগরিকরা একক প্ল্যাটফর্ম থেকে সব ধরনের সরকারি সেবা সহজে গ্রহণ করতে পারে। এছাড়াও সিঙ্গাপুর সরকার সাধারণ মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য সেকেন্ড হ্যান্ড কম্পিউটার বিতরণ, প্রশিক্ষণ কর্মসূচি এবং সরকারি কর্মচারীদের প্রযুক্তি শিক্ষায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়। এই প্রচেষ্টাগুলো সিঙ্গাপুরকে বিশ্বের আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে অগ্রগণ্য রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি যাত্রা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশে ই-গভর্নেন্সের যাত্রা শুরু হয় আনুষ্ঠানিকভাবে ২০০৮ সালে। এর ধারাবাহিকতায় ‘মাইগভ’ নামে একটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম চালু হয়েছে, যেখানে নাগরিকরা এক জায়গা থেকে সরকারি নানা সেবা নিতে পারছেন। বিশেষ করে কোভিড মহামারীর সময়ে জাতীয় পরিচয়পত্র যাচাই করে প্রায় ১৩ কোটি মানুষের টিকা প্রদান একটি বড় প্রযুক্তিগত সফলতা হিসেবে বিবেচিত হয়। বর্তমানে টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল শিক্ষা, ই-ফাইলিং, অনলাইন ট্রেড লাইসেন্স, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধনসহ নানা সরকারি সেবা অনলাইনে প্রদান করা হচ্ছে।
তবে বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জও কম নয়। এস্তোনিয়ার জনসংখ্যা মাত্র ১৪ লাখ এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস করে মাত্র ৪০ জন। অন্যদিকে, বাংলাদেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি এবং প্রতি বর্গকিলোমিটারে বাস ঘনত্ব প্রায় ৩৫০০ জনের কাছাকাছি। দেশের আয়তনও অনেক বেশি, যা ডিজিটাল অবকাঠামো গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা। তাছাড়া, দেশের গ্রামীণ ও অনগ্রসর এলাকায় এখনও ইন্টারনেট সংযোগের বিস্তার কম, মানুষ এখনও প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিতি এবং দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে। এইসব কারণে বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সরকারি সেবা সুষ্ঠুভাবে সকল নাগরিকের কাছে পৌঁছানোর জন্য আরও সময় ও পরিকল্পনা দরকার।
তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও বিভিন্ন প্রযুক্তিনির্ভর প্রতিষ্ঠান যেমন অ্যাসপায়ার টু ইনোভেট (এটুআই) নতুন নতুন উদ্যোগ হাতে নিয়েছে, যেগুলো দেশের ডিজিটাল সেবা বিস্তারে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তুলনা ও শেখার দিকনির্দেশনা
অবশ্যই, বাংলাদেশের উন্নয়ন যাত্রায় এস্তোনিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো ছোট ও স্বল্পজনসংখ্যার দেশগুলোর মডেল সরাসরি অনুসরণ করা সম্ভব নয়। আমাদের দেশ নিজের ভৌগোলিক, জনসংখ্যাগত ও সামাজিক-অর্থনৈতিক বাস্তবতা অনুযায়ী প্রযুক্তিগত পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে। তবে অন্য দেশগুলোর সফল অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজস্ব উদ্ভাবন ও আধুনিকীকরণ কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া যেতে পারে।
এই পথে এগোনোর জন্য পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা, রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দক্ষ ও প্রযুক্তি-প্রেমী মানবসম্পদ তৈরি অপরিহার্য। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। কারণ, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সেবা যদি জনগণের বড় অংশ ব্যবহার করতে না পারে, তাহলে সেটি কার্যকর ও ফলপ্রসূ হবে না।
ভবিষ্যতের দৃষ্টিকোণ
তথ্যপ্রযুক্তির এই দুই দশক আমাদের শিখিয়েছে যে, সঠিক দিশায় যদি পরিকল্পনা ও প্রয়াস চালানো হয়, তবে অগ্রগতি সম্ভব। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর সরকারি সেবা ব্যবস্থাকে আরও সুসংগঠিত, মানবিক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক করে তোলার প্রয়োজন। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষ যাতে প্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে, তার জন্য আরও বিস্তৃত প্রশিক্ষণ, অবকাঠামো উন্নয়ন এবং সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন।
এভাবে প্রযুক্তির মাধ্যমে সরকারি সেবার মান বৃদ্ধি পেলে বাংলাদেশ শুধু নিজেই এগিয়ে যাবে না, ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার ও সরকারি সেবায় উন্নয়নের জন্য অন্য অনেক দেশের জন্য অনুকরণীয় উদাহরণ হয়ে উঠবে। দুই দশকের পথচলায় দেশের অর্জন যেমন প্রশংসনীয়, তেমনি সামনে আরও উন্নতির জন্য বিশাল সুযোগ ও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সঠিক পথে অগ্রসর হলে বাংলাদেশ বিশ্বে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন করে পরিচিতি গড়ে তুলতে পারবে।
তাই তথ্যপ্রযুক্তির পথে বাংলাদেশ যে পথচলা শুরু করেছে, সেটি এখন আরও সুসংগঠিত, মানবিক এবং সর্বস্তরের মানুষের জন্য সহজবোধ্য করার সময় এসেছে। দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশের ডিজিটাল ভবিষ্যতকে শক্তিশালী করে তোলা হবে আমাদের পরবর্তী বড় চ্যালেঞ্জ এবং সাফল্যের মাপকাঠি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ