
ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্ত করে দুটি পৃথক বিভাগ— রাজস্ব নীতি এবং রাজস্ব প্রশাসন— গঠনের ঘোষণা আসে সরকারের পক্ষ থেকে। তবে এই সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে রাজস্ব বিভাগের প্রায় ৩৫ হাজার কর্মকর্তা ও কর্মচারী অসন্তোষে ফেটে পড়েন। এক সপ্তাহের টানা কর্মবিরতি এবং আন্দোলনের ফলে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রম কার্যত অচল হয়ে পড়ে।
আন্দোলন স্থগিত, কিন্তু অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে
রবিবার (২৫ মে) রাতের আলোচনায় সরকারের উচ্চপর্যায়ের আশ্বাসে রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জোট ‘জাতীয় রাজস্ব ঐক্য পরিষদ’ সাময়িকভাবে আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দেয়। সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়, ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে সংশোধিত অধ্যাদেশের মাধ্যমে এনবিআরকে একটি স্বতন্ত্র ও বিশেষায়িত বিভাগে রূপান্তরের পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
সরকার আরও আশ্বাস দেয় যে, ‘রাজস্ব নীতি ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা অধ্যাদেশ-২০২৫’ সংশোধন না হওয়া পর্যন্ত তা কার্যকর হবে না। অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে রাজস্ব নীতি পৃথকীকরণের কাঠামো গঠনের প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়।
শিল্প ও বন্দর কার্যক্রমে স্থবিরতা : প্রতিদিন ২৫০ মিলিয়ন ডলারের ক্ষতির শঙ্কা
বাংলাদেশ নিটওয়্যার প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিকেএমইএ) সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, প্রতিদিন প্রায় ২৫০ মিলিয়ন ডলারের রফতানি ঝুঁকির মুখে পড়ছে। বন্দরগুলোতে আটকে থাকা হাজার হাজার কনটেইনারে রয়েছে পচনশীল খাদ্যপণ্য, ওষুধ, ই-কমার্স মালামাল এবং গুরুত্বপূর্ণ কাঁচামাল।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানায়, ১৩ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৪,০০০ কনটেইনার বন্দরে আটকে গেছে। শুধু চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকেই বছরে প্রায় ৬৮,৮৬৭ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় হয়। ধর্মঘটে এধরনের সংগ্রহ কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
বন্দর অচল, চেইন ভেঙে পড়ার আশঙ্কা
চট্টগ্রাম বন্দর: দেশের ৯০ শতাংশ আমদানি-রফতানি এখানেই হয়। শনিবার বিকেল পর্যন্ত পুরোপুরি বন্ধ ছিল।
বেনাপোল কাস্টমস: একেবারেই বন্ধ।
ঢাকা, মোংলা, কমলাপুর: সীমিত পরিসরে চলছিল কার্যক্রম।
টানা কর্মবিরতির ফলে চট্টগ্রাম, বেনাপোল, মোংলা, ঢাকা কাস্টমস হাউজ, কমলাপুর ICD-তে পণ্য খালাস কার্যত বন্ধ হয়ে যায়। আটকে যায় হাজার হাজার কনটেইনার। এর ফলে কাঁচামাল, ওষুধ, পচনশীল খাদ্যপণ্য ও পোশাক শিল্পের মালামাল বন্দরে আটকে থাকে।
বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, “আমাদের এক্সপোর্ট শিডিউল ভয়াবহভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। অনেক বিদেশি ক্রেতা চুক্তি বাতিল করছে। শুধু তৈরি পোশাক নয়, সমগ্র রপ্তানি খাতই ঝুঁকিতে পড়েছে।”
চট্টগ্রাম চেম্বারের সভাপতি মাহবুবুল আলম বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর স্থবির থাকলে দেশের অর্থনীতি ঠান্ডা হয়ে পড়ে। প্রতিদিন ২০-২৫ কোটি ডলারের ক্ষতি হচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত: এই সিদ্ধান্ত কীভাবে দেশের অর্থনীতি ও প্রশাসনকে ঝুঁকিতে ফেলেছে
১. প্রশাসনিক অস্থিরতা ও সক্ষমতা নিয়ে প্রশ্ন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক ড. তানজিমউদ্দিন খান বলেন, “হঠাৎ করে এভাবে একটি প্রতিষ্ঠিত সংস্থাকে ভেঙে দুই ভাগে ভাগ করার সিদ্ধান্ত জনপ্রশাসনিক ভারসাম্যকে নষ্ট করে। সংস্কার প্রয়োজন, তবে তা হতে হবে কর্মীদের সঙ্গে আলোচনার ভিত্তিতে।”
২. বৈদেশিক সম্পর্ক ও বিনিয়োগ ঝুঁকিতে
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডি-এর নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “এই ধরনের প্রশাসনিক অস্থিরতা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সন্দেহ সৃষ্টি করে। রাজস্ব খাতের দুর্বলতা সরাসরি আমাদের বাজেট বাস্তবায়ন ও বৈদেশিক ঋণ ব্যবস্থাপনায় প্রভাব ফেলতে পারে।”
৩. আইএমএফ ও দাতা সংস্থার শর্ত আদৌ পূরণ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ
অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম বলেন, “আইএমএফ যেসব সংস্কারের কথা বলছে, তার মধ্যে স্বচ্ছতা, সক্ষমতা ও জবাবদিহিতা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখন যা হচ্ছে, তা হচ্ছে কার্যত আরও বড় প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা। এতে আইএমএফের ভরসা কমে যেতে পারে।”
বিদেশি বিনিয়োগে নেতিবাচক বার্তা
রাজস্ব খাতে প্রশাসনিক অস্থিরতা শুধু বাণিজ্য নয়, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও গৃহীত অর্থনৈতিক সংস্কার নিয়ে আন্তর্জাতিক আস্থাও ঝুঁকির মুখে ফেলে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ বড় দাতা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক ও সহযোগিতা প্রভাবিত হতে পারে।
শিল্প খাতে বিপর্যয়ের আশঙ্কা
তীব্র ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম, বেনাপোল, ঢাকা কাস্টমস হাউজে আমদানি কার্যক্রম একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। শিল্প-কারখানার কাঁচামাল আটকে থাকায় গার্মেন্টসসহ রপ্তানিমুখী খাতে উৎপাদন বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিদেশি ক্রেতারা ক্ষতিপূরণ দাবি করছে, কেউ কেউ অর্ডার বাতিল করছে— ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
রাজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অভিযোগ
আন্দোলনরত কর্মীরা বলছেন, তারা সংস্কারবিরোধী নন। তবে এনবিআরের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বিলুপ্ত করার আগে যেভাবে ‘অভ্যন্তরীণ আলোচনা ছাড়া অধ্যাদেশ জারি করা হয়েছে’, তা অগণতান্ত্রিক এবং অবমাননাকর।
জাতীয় রাজস্ব ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক ও কাস্টমস অ্যাসোসিয়েশনের নেতা রুহুল আমিন বলেন, “আমরা চাই সংস্কার হোক। কিন্তু সেটি হতে হবে রাজস্ব বিভাগের অংশীজনদের মতামতের ভিত্তিতে। নচেত প্রশাসনিক বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে এবং সেটি দেশের অর্থনীতিতে ভয়াবহ ক্ষতি আনবে।”
সাবেক এনবিআর কর্মকর্তার পর্যালোচনা
সাবেক চেয়ারম্যান ড. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, “একটি শক্তিশালী এনবিআর গড়ে তোলা দরকার ছিল। কিন্তু এখন যেভাবে এনবিআরকে ভেঙে নতুন বিভাগ করা হচ্ছে, এতে দক্ষতা হ্রাস পাবে। দুই সংস্থার মধ্যে সমন্বয় জটিলতা তৈরি হবে।”
সংকট কতটা গভীর?
প্রতিদিন রাজস্ব আদায়ে ঘাটতি: প্রায় ৫০০ কোটি টাকার রাজস্ব আদায় স্থবির হয়ে পড়ে।
রপ্তানি খাতে ক্ষতি: প্রতিদিন ২৫০ মিলিয়ন ডলারের রপ্তানি ঝুঁকির মুখে।
পণ্যবাহী কনটেইনার আটকে আছে: চট্টগ্রাম বন্দরে ৪,০০০ এর বেশি কনটেইনার আটকে রয়েছে।
ব্যবসায়ীদের ক্ষোভ: এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, বিকেএমইএ একযোগে দ্রুত সমাধানের দাবি জানিয়েছে।
সমাধান না হলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি
এই অস্থিরতা শুধু তাৎক্ষণিক রাজস্ব ঘাটতির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে দেশের বাজেট, বিনিয়োগ, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও প্রশাসনিক সক্ষমতার উপর। যদি স্বচ্ছতা ও অংশগ্রহণমূলক সংলাপের মাধ্যমে এই সংকটের সমাধান না হয়, তবে এটি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের অর্থনৈতিক কাঠামোকেই হুমকির মুখে ফেলবে।
সরকারি আশ্বাসে আন্দোলন আপাতত স্থগিত হলেও এনবিআর বিলুপ্তির সিদ্ধান্ত ঘিরে ভয়াবহ অনিশ্চয়তা রয়ে গেছে। রাজস্ব কর্মকর্তারা হতাশ, বিশেষজ্ঞরা শঙ্কিত, এবং ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত। এই মুহূর্তে সরকারের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে— সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে একটি স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাধান টেবিলে আনা, যাতে নীতিগত সংস্কার ও প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা একসাথে নিশ্চিত করা যায়।
বাংলাবার্তা/এসজে