
ছবি: সংগৃহীত
একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা এটিএম আজহারুল ইসলাম অবশেষে দেশের সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বেকসুর খালাস পেয়েছেন। প্রায় এক যুগ ধরে চলমান আইনি লড়াইয়ের পর মঙ্গলবার (২৭ মে) সকালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সাত সদস্যের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তার বিরুদ্ধে আনা সকল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেন। প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের নেতৃত্বে এই বেঞ্চ ঐতিহাসিক এ রায় ঘোষণা করে, যা দেশের বিচারিক ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
রায়ের পর এ মামলায় এটিএম আজহারের পক্ষে আইনজীবী শিশির মনির গণমাধ্যমকে জানান, “আজকের রায়ে এটিএম আজহারুল ইসলাম একজন নির্দোষ ব্যক্তি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ তাকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন। এটি শুধু একটি রায় নয়, এটি মিথ্যার পরাজয় ও সত্যের জয়।”
রায়ে আদালত চারটি গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন:
বিচার ব্যবস্থার রূপান্তরে ভুল সিদ্ধান্ত: আদালত উল্লেখ করেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশসহ গোটা ভারতীয় উপমহাদেশে ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থার কাঠামো পরিবর্তন ছিল একটি বড় ভুল, যা অনেক নির্দোষ মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করেছে।
প্রমাণ ছাড়া মৃত্যুদণ্ড: আদালতের ভাষায়, উপস্থাপিত সাক্ষ্য-প্রমাণের মূল্যায়ন না করেই এটিএম আজহারকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। এটি ছিল “বিচারের নামে অবিচার।”
সাক্ষ্য যাচাইয়ের ঘাটতি: পূর্ববর্তী আপিল বিভাগ যথাযথভাবে উপস্থাপিত তথ্যপ্রমাণ যাচাই করতে ব্যর্থ হয়েছে। এই ঘাটতির ফলেই একজন নির্দোষ ব্যক্তি দীর্ঘ সময় ধরে অন্যায়ভাবে সাজা ভোগ করেছেন।
আন্তর্জাতিক নজির: আদালত রায়ে উল্লেখ করেন, এই ধরনের ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের বিচার ব্যবস্থায় একটি অনন্য নজির হয়ে থাকবে, যেখানে সত্য শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছে।
শিশির মনির আরও বলেন, “আজহারুল ইসলাম সৌভাগ্যবান, কারণ তিনি আল্লাহর রহমতে বেঁচে ছিলেন এবং ন্যায়বিচার পেয়েছেন। আমরা বিশ্বাস করি, এই রায়ের মাধ্যমে পূর্বের বহু মামলার বিতর্কিত রায় নিয়ে নতুনভাবে ভাববার দরজা খুলে গেল।” তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান, পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর মানবতাবিরোধী অপরাধের অতীত রায়গুলো পুনর্বিবেচনা করতে যেন একটি “রিভিউ বোর্ড” গঠন করা হয়।
আদালতের কাছে এ দিন সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রদানের আবেদন জানানো হলে বিচারপতিরা সেটি মঞ্জুর করেন। আইনজীবীরা আশা প্রকাশ করেন, আজ অথবা আগামীকাল সংক্ষিপ্ত আদেশ প্রস্তুত হয়ে গেলে এটিএম আজহারুল ইসলামের মুক্তির সকল আইনি প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হবে।
রায়ের দিন আদালতে উপস্থিত ছিলেন জামায়াতের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। তাদের মধ্যে ছিলেন জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মো. তাহের, ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা এটিএম মাসুম, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান, অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জোবায়ের, অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন হেলাল, নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসেন, মাওলানা আব্দুল হালিম, অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান, মাসুদ সাঈদী, ড. হেলাল উদ্দিন, দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ।
রায়ের পর জামায়াত কর্মীরা আদালত প্রাঙ্গণে শুকরিয়া আদায় করেন এবং ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে শোকরানা নামাজ আদায় করা হয়।
উল্লেখ্য, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এটিএম আজহারুল ইসলামকে ২০১৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। তাকে রংপুরে ১৯৭১ সালে হত্যাকাণ্ড, গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো অপরাধে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। তবে আপিল বিভাগের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এসব অভিযোগ প্রমাণে যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ আদালতের সামনে ছিল না।
এই রায়ের মাধ্যমে এটিএম আজহারুল ইসলামের দীর্ঘদিনের একটি দুঃস্বপ্নের অবসান ঘটল। একইসঙ্গে ন্যায়বিচার, বিচার বিভাগের নিরপেক্ষতা এবং আইনের শাসনের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা পুনঃস্থাপিত হলো বলে অনেকেই মন্তব্য করছেন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, এই রায় শুধু এটিএম আজহারের জন্য নয়, বরং বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। যেখানে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হয়ে নিরপেক্ষভাবে বিচার করার সাহস এবং মানসিকতা আদালত দেখাতে সক্ষম হয়েছে।
এই রায় নতুন আলোচনার জন্ম দিচ্ছে—মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলাগুলোতে কতটুকু নিরপেক্ষতা বজায় রাখা হয়েছিল, কতটুকু আইনের শাসন মানা হয়েছিল—তা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে আবারো ভাবনার সময় এসেছে।
এটিএম আজহারের খালাস শুধু একটি রায়ের প্রতিফলন নয়; এটি ইতিহাস, ন্যায়বিচার, এবং মানবাধিকারের চূড়ান্ত সমন্বয়—যা আগামী দিনের জন্য একটি শিক্ষনীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ