
ছবি: সংগৃহীত
সারাদেশে সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে চরম অসন্তোষ এবং ক্ষোভের সূত্রপাত ঘটিয়েছে সদ্য জারি হওয়া ‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ ২০২৫’। এর প্রতিবাদে আজ মঙ্গলবার (২৭ মে) সকাল থেকে দেশের সব জেলা, বিভাগীয় শহর ও উপজেলায় বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে একযোগে বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে রাজধানীর সচিবালয়ে বিরাট জমায়েত হওয়ার পাশাপাশি দেশের প্রতিটি সরকারি কার্যালয়ের সামনে আজ উত্তাল বিক্ষোভের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।
পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, এই বিক্ষোভের সম্ভাব্য উত্তেজনা ও নিরাপত্তা ঝুঁকি মাথায় রেখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সচিবালয়ে আজ সব ধরনের দর্শনার্থী প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে। পাশাপাশি ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সচিবালয় সংলগ্ন এলাকায় যেকোনো ধরনের সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে।
তবে নিরাপত্তা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সোমবার থেকেই সচিবালয় চত্বরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবিতে বেলা ১১টার দিকে নিজ নিজ মন্ত্রণালয় ও দপ্তর থেকে বেরিয়ে এসে শত শত কর্মকর্তা-কর্মচারী বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ভবনের সামনে জমায়েত হন। তারা ‘অধ্যাদেশ মানি না’, ‘কালো আইন বাতিল কর’, ‘আমার অধিকার ফিরিয়ে দাও’ ইত্যাদি স্লোগানে মুখরিত করেন রাজধানীর প্রশাসনিক প্রাণকেন্দ্র।
সোমবারের এই তৃতীয় দিনের আন্দোলনে নতুন করে ঘোষণা আসে যে, মঙ্গলবার অর্থাৎ আজ সারা দেশে একযোগে বিক্ষোভ হবে, আর বুধবার (২৮ মে) পালন করা হবে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি। কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতারা বলেন, “সরকার আমাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই একটি একপাক্ষিক ও দমনমূলক অধ্যাদেশ জারি করেছে। এটি শুধুমাত্র চাকরিজীবীদের শাস্তি নিশ্চিত করার জন্য প্রণীত হয়েছে, কিন্তু কোনো আইনি প্রতিকার বা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ রাখা হয়নি।”
তারা আরও বলেন, “এই অধ্যাদেশ একটি কালো আইন। এর মাধ্যমে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে সরকারি কর্মচারীদের সরাসরি চাকরি থেকে বরখাস্ত বা শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব, অথচ কোনো তদন্ত কমিটি বা আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ করার বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি। এটি সংবিধান পরিপন্থি ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।”
বিক্ষোভে অংশ নেওয়া কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা শুধু অধ্যাদেশ বাতিল নয়, বরং সংশোধিত এই অধ্যাদেশ তৈরির প্রক্রিয়ায় যুক্ত সব সচিব, উচ্চপদস্থ আমলা ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অপসারণেরও দাবি জানিয়েছেন।
উল্লেখ্য, গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের এক বৈঠকে নতুন সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের খসড়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। পরে রোববার (২৫ মে) সন্ধ্যায় তা গেজেট আকারে প্রকাশ করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এরপর থেকেই চরম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় সরকারি চাকরিজীবীদের মধ্যে।
আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করছেন, বারবার আলোচনার আশ্বাস দিলেও সংশোধিত অধ্যাদেশে চাকরিজীবীদের মতামত একেবারেই উপেক্ষা করা হয়েছে। বরং এই আইনের মাধ্যমে কর্মীদের দমন করার হাতিয়ার তৈরি করা হয়েছে।
সোমবার সকাল থেকেই সচিবালয়ের বাণিজ্য ভবনের সামনে জড়ো হতে শুরু করেন শতাধিক দপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের সংখ্যা হাজার ছাড়িয়ে যায়। এরপর মিছিল নিয়ে তারা একে একে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় এবং আইন মন্ত্রণালয়ের সামনের সড়কে অবস্থান নিয়ে প্রতিবাদ করেন।
অনেক দপ্তরে স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়। বেশ কয়েকটি দপ্তরে ফাইলচালাচালি বন্ধ হয়ে যায়। এতে সাধারণ নাগরিকদের সেবাও ব্যাহত হয়। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাড়তি সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হলেও, আন্দোলনকারীরা শান্তিপূর্ণ অবস্থানে থাকেন।
কর্মকর্তা-কর্মচারী ঐক্য ফোরামের নেতারা বলছেন, তারা কোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে আন্দোলনে নামেননি। বরং চাকরিজীবীদের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত ও হয়রানিমূলক আইনের বিরুদ্ধেই এ কর্মসূচি।
তারা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, “এই আন্দোলন শুধু বিক্ষোভে সীমাবদ্ধ থাকবে না। প্রয়োজনে আমরা লাগাতার কর্মবিরতি ও রাজপথে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছি। প্রয়োজনে দেশের সকল জেলা প্রশাসন ও উপজেলা পরিষদেও কর্মবিরতি হবে।”
সরকারি চাকরির নিয়মনীতির কাঠামোয় এমন রদবদল সচরাচর দেখা যায় না। তবে আলোচনার মাধ্যমে না গিয়ে, সরাসরি গেজেট আকারে এ অধ্যাদেশ জারি করায় যে বিক্ষোভের সূচনা হয়েছে, তা যে আরও বিস্তৃত আকার ধারণ করতে যাচ্ছে—তা আন্দাজ করা কঠিন নয়। এখন সরকারের সামনে দুটি পথ খোলা: হয় আলোচনা ও পুনর্বিবেচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া, নয়তো বিক্ষোভ দমন করে প্রশাসনিক কাঠামোয় দীর্ঘমেয়াদি অস্থিরতা ডেকে আনা।
সরকারি চাকরিজীবীদের এই আন্দোলন কেবল একটি অধ্যাদেশ বাতিলের দাবি নয়, বরং তাদের অধিকার, মর্যাদা এবং নিরাপত্তার জন্য নতুন এক সংগ্রামের রূপরেখা হয়ে উঠছে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ