
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশে বিশেষ করে শহরাঞ্চলে ‘চা-সিগারেট’ একটি পরিচিত দৃশ্য। নানা সময়ে আড্ডা জমে ওঠে চায়ের দোকানে, যেখানে এক কাপ গরম দুধ চায়ের সঙ্গে জ্বলছে সিগারেট। অনেকের জীবনের একটি অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে এই ধূমপান ও চা সেবন। কিন্তু এই অভ্যাসটি শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর, তা অনেকেই ভাবেন না। নতুন গবেষণায় জানা গেছে, চায়ের সঙ্গে ধূমপান করলে শরীরের নানা অংশ মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়ে, যার ফলে রোগব্যাধি এবং মৃত্যুর আশঙ্কা বেড়ে যায়।
প্রতিদিনের ছোটখাটো সময় কাটানোর অংশ হিসেবে অনেকেই সকালে কিংবা বিকেলে এক কাপ গরম চায়ের সঙ্গে সিগারেট ধরিয়ে নেন। এটি হয়তো তাদের জীবনের অপরিহার্য অংশ মনে হলেও এর ক্ষতিকর প্রভাব দেহের ওপর মারাত্মক।
‘অ্যানালস অফ ইন্টারনাল মেডিসিন’ নামের আন্তর্জাতিক মেডিকেল জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় উঠে এসেছে, গরম চা খাওয়ার সঙ্গে ধূমপান করার ফলে খাদ্যনালীর কোষগুলোতে মারাত্মক ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। এটি গলার ও খাদ্যনালীর ক্যান্সারের ঝুঁকি অত্যন্ত বৃদ্ধি করে। গরম চায়ের পান ও ধূমপানের যৌথ প্রভাব শরীরের ভেতরের একাধিক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।
চায়ের প্রধান উপাদান ক্যাফেইন একটি স্টিমুলেন্ট, যা শরীরে হজম প্রক্রিয়াকে কিছুটা ত্বরান্বিত করে। তবে বেশি মাত্রায় ক্যাফেইন গ্রহণ পাকস্থলীর আস্তরণকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। অন্যদিকে, সিগারেটে থাকা নিকোটিন এবং অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিকগুলো শরীরের কোষগুলোর ক্ষতি করে এবং দীর্ঘমেয়াদে হৃদরোগ, ক্যান্সারসহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বাড়ায়।
বিশেষত খালি পেটে চা ও সিগারেট একসঙ্গে নেওয়া হলে মস্তিষ্কে রক্তসঞ্চালনের ব্যাঘাত ঘটাতে পারে, যার ফলে মাথা ঘোরা, মাথাব্যথা, অবসাদ এবং নানা ধরনের শারীরিক অসুবিধার সৃষ্টি হয়। এসব উপসর্গ সময়ের সঙ্গে বৃদ্ধি পেলে তা গুরুতর রোগের রূপ নিতে পারে।
চায়ের ধোঁয়া এবং সিগারেটের ধোঁয়া মিলিয়ে ফুসফুসের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলে। ধোঁয়ার ক্ষতিকর কণাগুলো ফুসফুসের কোষকে অবনতি ঘটায়, যা ক্যান্সারের জন্য এক অন্যতম কারণ হিসেবে বিবেচিত। ফুসফুসের ক্যান্সার ছাড়াও হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, যেমন হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ে।
চিকিৎসকদের মতে, যারা ধূমপান করেন, তাদের হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি সাধারণ মানুষের তুলনায় প্রায় ৭০ শতাংশ বেশি। এর ফলে তাদের আয়ু গড়ে ১৫-২০ বছর কমে যেতে পারে। ধূমপানের কারণে শরীরের রক্তনালীগুলো সংকুচিত হয়ে যায়, যা রক্তসঞ্চালন ব্যাহত করে এবং শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গে অক্সিজেনের অভাব ঘটায়।
গরম চায়ের সঙ্গে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাস থেকে যে সকল রোগের ঝুঁকি তৈরি হয়, তা মোটেই কম নয়। এর মধ্যে প্রধান রোগগুলো হলো:
খাদ্যনালীর ক্যান্সার: গরম চায়ের তাপ এবং ধূমপানের বিষাক্ত পদার্থ খাদ্যনালীর কোষের জেনেটিক স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করে ক্যান্সারের সম্ভাবনা বাড়ায়।
ফুসফুসের ক্যান্সার: ধোঁয়ার উপাদান ফুসফুসের কোষে প্রদাহ ও জৈব বিকৃতি ঘটায়।
হার্টের রোগ: রক্তনালীতে প্লাক জমা, রক্তচাপ বৃদ্ধি ও হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি।
গলার ক্যান্সার ও পাকস্থলীর আলসার: গরম চায়ের তাপ ও নিকোটিনের যৌথ প্রভাব।
ব্রেন স্ট্রোক: রক্ত সঞ্চালনে বিঘ্ন ঘটিয়ে মস্তিষ্কে স্ট্রোক হওয়ার সম্ভাবনা।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলছেন, চায়ের সঙ্গে ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে মুক্তির জন্য এখনই পদক্ষেপ নেওয়া উচিত। সচেতনতা বৃদ্ধি ও অভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানো সম্ভব। বিকল্পে চা পান করা যেতে পারে কম ক্যাফেইনযুক্ত বা হারবাল চায়ের, এবং ধূমপান পরিহার করলে শরীর সুস্থ থাকবে দীর্ঘদিন।
চিকিৎসকরা পরামর্শ দিচ্ছেন, যারা নিয়মিত চায়ের সঙ্গে সিগারেট খেয়ে থাকেন, তারা যেন দ্রুত এই অভ্যাস থেকে মুক্তি পান। সময়ের সঙ্গে সাথে শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাওয়ায়, এই অভ্যাস দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক রোগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। সুস্থ ও দীর্ঘায়ু জীবনযাপনের জন্য এই বদঅভ্যাস থেকে বেরিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
চায়ের সঙ্গে ধূমপান একটি মারাত্মক ক্ষতিকর অভ্যাস, যা শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে ধ্বংস করে দিচ্ছে এবং মানুষের আয়ু হ্রাস করছে। গরম চায়ের তাপ এবং সিগারেটের বিষাক্ত পদার্থ একত্রে শরীরের ক্যান্সারসহ নানা ভয়াবহ রোগের ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি করে। তাই স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ার জন্য ও সুস্থ জীবন যাপনের লক্ষ্যে চায়ের সঙ্গে ধূমপান থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা উচিত। এখনই এই ক্ষতিকর অভ্যাস থেকে সরে এসে স্বাস্থ্যকর জীবন শুরু করা সময়ের দাবি।
বাংলাবার্তা/এমএইচ