
ছবি: সংগৃহীত
হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক—এই বাক্যটি আজ আর তেমন বিস্ময়ের কারণ নয়। কর্মব্যস্ত জীবনের চাপ, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস, অনিয়মিত জীবনযাপন এবং স্ট্রেসের ফলে বিশ্বজুড়ে হৃদরোগের প্রকোপ বেড়েই চলেছে। কিন্তু যতটা হঠাৎ করে হার্ট অ্যাটাক ঘটে বলে মনে হয়, বাস্তবে তার আগেই শরীর আমাদের সতর্ক সংকেত পাঠাতে থাকে। এই সংকেতগুলো আমরা অধিকাংশ সময়েই অবহেলা করি। বিশেষজ্ঞদের মতে, হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ না ঘটলেও, এর আগাম ইঙ্গিতগুলো যদি মনোযোগ সহকারে লক্ষ করা যায়, তাহলে বড় বিপদ এড়ানো সম্ভব।
এই আগাম সংকেতগুলোর মধ্যে চোখ একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হয়ে উঠছে। সাম্প্রতিক চিকিৎসা গবেষণায় উঠে এসেছে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য—হার্ট অ্যাটাক হওয়ার প্রায় ৩০ দিন আগেই চোখে কিছু লক্ষণ দেখা দিতে পারে। এই লক্ষণগুলোর মধ্যে চারটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, যা নিয়মিতভাবে চিহ্নিত করা গেলে হৃদরোগের সম্ভাবনা অনেকটাই কমানো সম্ভব।
চোখে দেখা দেয় যে ৪টি বড় লক্ষণ, যা হার্ট অ্যাটাকের পূর্বাভাস দিতে পারে:
১. চোখের চারপাশে সাদা বা হলুদ দাগ—জ্যানথেলাসমা
চোখের পাতার আশেপাশে হালকা সাদা বা হলুদ বর্ণের চর্বিযুক্ত স্তর দেখা গেলে, তাকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় জ্যানথেলাসমা। এটি মূলত চর্বি জমে যাওয়ার একটি প্রক্রিয়া, যা রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা অতিরিক্ত বেড়ে যাওয়ার ইঙ্গিত দেয়। এই চর্বি শুধু চোখের চারপাশেই জমে না, একইভাবে হৃদপিণ্ডের ধমনী বা করনারি আর্টারিতেও জমতে থাকে, যার ফলাফল হতে পারে প্রাণঘাতী হার্ট অ্যাটাক।
এই দাগগুলো সাধারণত ব্যথাহীন এবং ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। অনেকেই এটিকে কসমেটিক সমস্যা বলে ভাবেন, কিন্তু এটি আসলে এক ধরনের মেডিক্যাল অ্যালার্ম। বিশেষ করে ৪০ বছর বয়সের পর এই দাগ দেখা দিলে অবিলম্বে রক্তে লিপিড প্রোফাইল পরীক্ষা করে নেওয়া জরুরি।
২. চোখের মণির চারপাশে ধূসর বা সাদা রিং—আর্কাস সিনিলিস
আরেকটি উল্লেখযোগ্য লক্ষণ হলো—চোখের কর্নিয়ার চারপাশে একটি ধূসর বা হালকা সাদা বৃত্ত। একে বলা হয় আর্কাস সিনিলিস। যদিও এটি বয়সজনিত একটি সাধারণ পরিবর্তন, তবে বয়স ৪৫-এর কম হলে এটি একাধিক হৃদরোগের পূর্বাভাস হতে পারে।
এই রিং আসলে চোখে চর্বি জমার ফল। তবে এটি চোখে কোনো সমস্যা তৈরি না করলেও, শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে এটি দেখা দেয়। চিকিৎসকরা বলেন, যারা উচ্চ রক্তচাপ, টাইপ-২ ডায়াবেটিস, স্থূলতা বা পরিবারে হৃদরোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদের মধ্যে এই লক্ষণটি দেখা গেলে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে দেখা উচিত।
৩. চোখে ঘন ঘন ঝাপসা দেখা বা দৃষ্টিশক্তি হ্রাস
দৃষ্টিশক্তির আকস্মিক পরিবর্তন, বিশেষ করে বারবার চোখ ঝাপসা হয়ে যাওয়া, চোখে ঝিনঝিন বা ভারী অনুভব হওয়া, এমনকি কিছুক্ষণের জন্য দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে যাওয়া—এসবকেই হৃদপিণ্ডের রক্ত সরবরাহের সমস্যার আগাম লক্ষণ হিসেবে ধরা হয়। বিশেষ করে যখন মস্তিষ্ক বা চোখে সঠিক পরিমাণে রক্ত পৌঁছায় না, তখন এসব সমস্যা দেখা দেয়।
এই সমস্যা যারা দীর্ঘদিন ধরে শারীরিকভাবে নিষ্ক্রিয়, মানসিকভাবে চাপগ্রস্ত বা অনিয়মিত খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত, তাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এটি স্ট্রোকের পূর্বাভাসও হতে পারে, যা হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকিকে আরও বাড়িয়ে তোলে।
৪. চোখে ফোলাভাব, লালচে ভাব ও ভারী অনুভূতি
চোখের নিচে ক্রমাগত ফোলাভাব এবং লালচে ভাব হৃদরোগের একটি মারাত্মক লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। শরীর যদি অতিরিক্ত তরল ধারণ করতে শুরু করে এবং হৃদপিণ্ড যদি ঠিকমতো রক্ত পাম্প করতে না পারে, তাহলে শরীরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে চোখে, ফোলাভাব সৃষ্টি হয়।
এই লক্ষণগুলোর সঙ্গে চোখে বারবার জ্বালাপোড়া, ক্লান্তি বা ভারী ভাব দেখা দিলে বিষয়টি আর উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। এটি কেবল চোখের ক্লান্তি নয়, বরং এটি হতে পারে হার্ট ফেলিওরের প্রাথমিক সংকেত।
সঠিক সময়ে চিকিৎসা পরামর্শ নেওয়া যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই প্রতিদিনের জীবনধারায় কিছু পরিবর্তন এনে হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি অনেকটাই কমানো সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা নিচের অভ্যাসগুলো নিয়মিত অনুসরণ করার পরামর্শ দেন—
স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণ করুন: চর্বি ও কোলেস্টেরলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলুন।
বেশি করে শাকসবজি, তাজা ফল, ওটস, বাদাম এবং মাছ খান।
রেড মিট, প্রসেসড ফুড এবং ফাস্ট ফুড যতটা সম্ভব কম খেতে হবে।
প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট ব্যায়াম করুন: দ্রুত হাঁটা, হালকা জগিং, সাইক্লিং বা সাঁতার চমৎকার ব্যায়াম।
অফিসে দীর্ঘক্ষণ বসে থাকলে প্রতি ঘন্টায় উঠে কিছুক্ষণ হাঁটুন।
মানসিক চাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন: স্ট্রেস হৃদপিণ্ডের বড় শত্রু। নিয়মিত মেডিটেশন, যোগব্যায়াম বা মাইন্ডফুলনেস চর্চা করুন।
ঘুম ঠিকভাবে না হলে স্ট্রেস আরও বাড়ে। প্রতিদিন অন্তত ৭–৮ ঘণ্টা ঘুমাতে চেষ্টা করুন।
ধূমপান ও অ্যালকোহল বর্জন করুন: ধূমপান হৃদরোগের সবচেয়ে বড় কারণগুলোর একটি। এটি রক্তনালিকে সংকুচিত করে হৃদপিণ্ডে রক্ত চলাচল কমিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত অ্যালকোহল পান রক্তচাপ বাড়িয়ে দেয় এবং হার্টের গঠন ক্ষতিগ্রস্ত করে।
চোখ শুধু আত্মার আয়না নয়, তা শরীরের অভ্যন্তরীণ সংকেতও বহন করে। চোখের কিছু অসাধারণ পরিবর্তন আগাম হার্ট অ্যাটাকের ইঙ্গিত দিতে পারে, যা যথাসময়ে চিহ্নিত হলে জীবন বাঁচানো সম্ভব। নিজের শরীরের প্রতি মনোযোগ দিন, নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা করান এবং জীবনধারায় সচেতনতা আনুন। হৃদপিণ্ড ভালো তো জীবন ভালো—এই উপলব্ধিই আপনাকে রক্ষা করতে পারে এক মারাত্মক বিপদ থেকে।
বাংলাবার্তা/এমএইচ