
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান আয় উৎস জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)-এর রাজস্ব আদায়ে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন প্রবৃদ্ধি দেখা দিয়েছে। চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম ১০ মাসে (জুলাই থেকে এপ্রিল পর্যন্ত) রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি মাত্র ৩.২৪ শতাংশে আটকে রয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য মারাত্মক উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই প্রবৃদ্ধির হার ২০১৯-২০ অর্থবছরের করোনা সংকটকালে দেখা প্রবৃদ্ধি ১.৯৬ শতাংশের থেকেও সামান্যই বেশি। বিশ্লেষকরা বলছেন, চলমান ব্যবসায়িক মন্দা, কর্মবিরতি, এবং রাজস্ব সংগ্রহ ব্যবস্থার অব্যবস্থাপনা মিলিয়ে দেশের রাজস্ব খাত বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে।
এনবিআরের কর্মকর্তাদের টানা কর্মবিরতি এবং বিক্ষোভের ফলে মে মাসের গুরুত্বপূর্ণ রাজস্ব আদায় মৌসুমে কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেছে। গত কয়েক মাসে এনবিআরের রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ায় প্রথম ১০ মাসে সরকারের রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় বিশাল ঘাটতি দেখা দিয়েছে। চলতি অর্থবছরে এনবিআরের নির্ধারিত রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য ছিল চার লাখ ৬৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। কিন্তু এপ্রিল পর্যন্ত আদায় মাত্র দুই লাখ ৮৭ হাজার ২৫৭ কোটি টাকাই হয়েছে, যার ফলে ৭১ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকার ঘাটতি রয়ে গেছে। এটি সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ কার্যক্রমের বড় ব্যর্থতার ইঙ্গিত বহন করছে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, সাধারণত মে ও জুন মাসে রাজস্ব আদায় সর্বাধিক হয়। কিন্তু চলমান কর্মবিরতির কারণে এই দুই মাসের আদায় লক্ষ্যমাত্রার অনেক নিচে থাকবে বলে আশঙ্কা রয়েছে। তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, ‘যদি সরকারের সদিচ্ছা ও সমর্থন থাকে, তবে এই ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’
রাজস্ব আদায়ে গুরত্বপূর্ণ তিনটি খাত—ভ্যাট, আমদানি-রপ্তানি ও আয়কর—এনবিআরের লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থ হয়েছে। ভ্যাট খাতে নির্ধারিত লক্ষ্য ছিল এক লাখ ২৯ হাজার ৪২২ কোটি টাকা, কিন্তু আদায় হয়েছে মাত্র এক লাখ ১১ হাজার ২০২ কোটি টাকা। এ অর্থে প্রবৃদ্ধি থাকলেও তা লক্ষ্যমাত্রার থেকে অনেক কম। আমদানি-রপ্তানি খাতে লক্ষ্যমাত্রা এক লাখ এক হাজার ৬৩০ কোটি টাকা হলেও আদায় হয়েছে ৮১ হাজার ১১৬ কোটি টাকা, যা ঋণাত্মক প্রবৃদ্ধির নির্দেশ দেয়। আয়কর আদায়ও লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় অনেক কম, যেখানে নির্ধারিত লক্ষ্য ছিল এক লাখ ২৭ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা, কিন্তু আদায় মাত্র ৯৪ হাজার ৯৩৮ কোটি টাকা। বিশেষ করে শেষ দুই মাসে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে আদায় লক্ষ্যমাত্রার থেকে ৩৮.০২ শতাংশ কম।
রাজস্ব আদায়ের মৌসুম মে ও জুন মাসে বন্দরগুলোতে শুল্কায়ন কার্যক্রম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কিন্তু চলমান কর্মবিরতির কারণে চট্টগ্রাম বন্দরে ৪২ হাজারের বেশি কনটেইনার আটকা পড়েছে, যা বন্দরের জায়গা সংকট এবং কর্মবিরতির সম্মিলিত ফল। ভাসমান অবস্থায় রয়েছে আরও ১৮টি জাহাজ। এতে তৈরি পোশাক ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল আমদানি বিলম্বিত হয়েছে। বেনাপোল, তামাবিলসহ অন্যান্য স্থলবন্দরেও একই অবস্থা বিরাজ করছে। ভারতের সীমান্তের পেট্রাপোলে ৫৫০টির বেশি ট্রাক আটকা পড়েছে, আর তামাবিলে পাথর ও চুনাপাথরের পরিবহন বিঘ্নিত হচ্ছে। এসব জটিলতা সরাসরি দেশের রপ্তানি ও আমদানি কার্যক্রমকে প্রভাবিত করছে এবং অর্থনীতির গতি ধীর করে দিচ্ছে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) বলছে, যদি এই পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে, তবে চলতি অর্থবছরের শেষে রাজস্ব ঘাটতি এক লাখ কোটি টাকারও ওপরে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। এ ধরনের বড় ঘাটতি সরকারের উন্নয়ন ব্যয় এবং সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির জন্য সংকট সৃষ্টি করবে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই অবস্থা শুধু বর্তমান অর্থবছরের জন্যই নয়, দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্যও মারাত্মক হুমকি হয়ে উঠবে।
চলতি অর্থবছরের শুরুতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, এরপর রাজনৈতিক পরিবর্তন ও আইন-শৃঙ্খলার অবনতি এনবিআরের কার্যক্রমকে উল্লেখযোগ্যভাবে ধীর করে দিয়েছে। ডিসেম্বর মাস থেকে কিছুটা গতি ফিরে পেলেও এপ্রিল-মে মাসের আন্দোলনের ফলে রাজস্ব আদায়ে আবারও ভাটা পড়েছে। এসব কারণে সরকারি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য পূরণ করা অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের আশ্বাস অনুযায়ী, এনবিআর সংস্কার নিয়ে চলমান বিরোধের কারণে স্থগিত থাকা কর্মসূচি বর্তমানে স্থগিত রয়েছে। গতকাল থেকে রাজস্ব আদায় ও শুল্ক কার্যক্রম অনেকটা স্বাভাবিক হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি এসেছে। তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতার জন্য এনবিআরের দক্ষতা ও কার্যক্রমের সংস্কার জরুরি, যাতে ভবিষ্যতে এমন বড় ধরনের ঘাটতি এড়ানো যায়।
আগামী ২ জুন অর্থমন্ত্রী ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। বাজেট ঘোষণার আগে এমন বিশাল রাজস্ব ঘাটতির চিত্র সরকারের জন্য বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ। অর্থনৈতিক কার্যক্রমের সংকট কাটাতে রাজস্ব আদায়ে গতি ফেরানো ও কর্মবিরতি সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
চলমান রাজস্ব আদায়ের সংকট ও কর্মবিরতি অব্যাহত থাকলে দেশের অর্থনীতি দুর্বল হবে, যার প্রভাব পড়বে উন্নয়ন কার্যক্রম, বিনিয়োগ, এবং জনগণের জীবনযাত্রায়। তাই এখনই প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ ও সরকারের সক্রিয় হস্তক্ষেপ।
বাংলাবার্তা/এমএইচ