
ছবি: সংগৃহীত
বাংলাদেশের অপরাধ জগতের সবচেয়ে ভয়ংকর ও কুখ্যাত সন্ত্রাসীদের একজন সুব্রত বাইনকে অবশেষে তার অন্যতম সহযোগী মোল্লা মাসুদসহ কুষ্টিয়া থেকে গ্রেফতার করেছে সেনাবাহিনীর একটি চৌকস দল। বহু বছর ধরে পলাতক থাকা এই শীর্ষ সন্ত্রাসীর গ্রেফতারকে দেশের নিরাপত্তা ব্যবস্থার জন্য এক যুগান্তকারী সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে পরিকল্পিত ও ঝুঁকিপূর্ণ এই অভিযান পরিচালনা করা হয় মঙ্গলবার (২৭ মে) সকালে।
দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানিয়েছে, কুষ্টিয়া জেলা কারাগারের পেছনের একটি নিরিবিলি বাসা বেছে নিয়েছিল সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদ, যেখানে তারা দীর্ঘদিন ধরে আত্মগোপনে ছিল। তবে সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা ইউনিট অনেক দিন ধরেই তাদের গতিবিধি নজরে রাখছিল। অবশেষে মঙ্গলবার ভোরে সেনাবাহিনীর একটি অভিজাত ও প্রশিক্ষিত কমান্ডো টিম সেই বাসাটি ঘিরে ফেলে। অভিযান পরিচালনা করার সময় বাসার ভেতরে অবস্থান করছিল দুই সন্ত্রাসী। দীর্ঘক্ষণ নজরদারি ও প্রস্তুতির পর নিরাপদে প্রবেশ করে দুজনকেই জীবিত অবস্থায় আটক করে।
অভিযানের সময় সন্ত্রাসীদের কাছ থেকে দুটি অত্যাধুনিক পিস্তল, চারটি ম্যাগাজিন এবং মোট ১০ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়েছে। এতে স্পষ্ট হয়েছে যে তারা যে কোনো মুহূর্তে বড় ধরনের সহিংসতায় জড়াতে প্রস্তুত ছিল। এই অস্ত্রগুলো ব্যবহার করে তারা কী ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পরিকল্পনা করছিল, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
আটকের পরপরই সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে কড়া নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। রাজধানীর একটি বিশেষ নিরাপত্তা কেন্দ্রে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে এবং সন্ত্রাস দমন সংক্রান্ত মামলাগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততা যাচাই করা হবে।
সুব্রত বাইন দীর্ঘদিন ধরে দেশের অন্যতম ভয়ঙ্কর ও কুখ্যাত সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত। ১৯৯০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০০০ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় একের পর এক চাঁদাবাজি, খুন, সন্ত্রাসী হামলা, অস্ত্রের কারবার এবং রাজনৈতিক সহিংসতার পেছনে ছিল তার নাম। এক সময় সে রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় অপরাধজগতের ‘ডন’ হিসেবে আবির্ভূত হয়।
বিভিন্ন গোয়েন্দা রিপোর্টে উঠে এসেছে, সে দেশের ভেতরে ও বাইরে থেকে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো এবং বিভিন্ন অঞ্চলে তার মদদপুষ্ট বাহিনী কাজ করতো। ২০০০ সালের পর থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরে চলে আসার পর থেকে সে আত্মগোপনে চলে যায়। ভারত, থাইল্যান্ডসহ একাধিক দেশে সে পালিয়ে থাকার সময় অনেকবার তার অবস্থান শনাক্ত করা হলেও গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
সুব্রত বাইন যাকে তার ডানহাত হিসেবে ব্যবহার করতো, সেই মোল্লা মাসুদও একাধিক খুন, অস্ত্র মামলা, চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে অভিযুক্ত। সুব্রতের মতোই মাসুদও বহু বছর ধরে পলাতক ছিল। সম্প্রতি তারা একসঙ্গে আবার সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করছিল বলে গোয়েন্দাদের ধারণা।
সেনাবাহিনীর এই সফল অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলাফল স্পষ্ট হয়েছে। দেশের অভ্যন্তরে সন্ত্রাসী নেটওয়ার্ক যতই সুগঠিত হোক না কেন, রাষ্ট্রের গোয়েন্দা নজরদারি এবং অপারেশন সক্ষমতা যে অনেক শক্তিশালী ও কার্যকর—এই অভিযান তার প্রমাণ।
সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানিয়েছেন, এ ধরনের সন্ত্রাসীদের পুনরায় সংগঠিত হওয়ার যে চেষ্টা চলছিল, তা এবার স্থায়ীভাবে থামিয়ে দেওয়া হবে। গ্রেফতার হওয়া দুই সন্ত্রাসীর কাছ থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে দেশে ও দেশের বাইরে থাকা অপরাধী চক্রগুলোকে খুঁজে বের করে আইনের আওতায় আনার কাজ চলছে।
ঢাকায় নিয়ে আসার পর র্যাব, পুলিশ এবং গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যৌথভাবে সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে। তাদের বিরুদ্ধে পুরোনো ও চলমান মামলাগুলো পুনরায় তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে নতুন কোনো তথ্য পাওয়া গেলে সেসব অপরাধের জন্যও নতুন মামলা দায়ের করা হতে পারে।
দেশবাসী দীর্ঘদিন ধরে যেসব শীর্ষ সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে আসছিল, সুব্রত বাইন ও মোল্লা মাসুদের গ্রেফতার তার বড় সাড়া। এখন দেখার বিষয়, এই ঘটনার পর সন্ত্রাসবিরোধী অভিযানে কতটা গতি আসে এবং কত দ্রুত তাদের বিচারের মুখোমুখি করা যায়।
বাংলাবার্তা/এমএইচ